“ছুটিছাটা, বিরতি, বাঁধাধরা কাজের সময় — কিছুই নেই।”

হায়দরাবাদ-কেন্দ্রিক একটি একত্রিত ট্যাক্সি কোম্পানির হয়ে গাড়ি চালান শেখ সালাউদ্দিন। ৩৭ বছর বয়সি সালাউদ্দিন স্নাতক স্তর পাশ করেছেন বটে, কিন্তু চুক্তিপত্র না পড়েই সই করেছেন নথিতে। কোম্পানির নাম অবশ্য মুখে আনতে নারাজ তিনি। “হাজারটা আইনি শব্দে ঠাসা চুক্তিটা।” কেবল ডাউনলোড করা অ্যাপেই কনট্র্যাক্টটি আছে, আদতে কোনও কাগজপত্র নেই।

“কোনও চুক্তিতে সই করিনি,” বললেন ডেলিভারি কর্মী রমেশ দাস (নাম পরিবর্তিত)। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বাহা রুনা থেকে রমেশ কিন্তু আইনি জামানতের খোঁজে কলকাতায় এসে ওঠেননি, তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই — যথাশীঘ্র সম্ভব একটা কাজ জোগাড় করা। “খাতায়-কলমে কোত্থাও কোনও লেখাপড়া নেই। আমাদের আইডিগুলো [পরিচয়পত্র] অ্যাপের মধ্যেই আছে — ওটাই একমাত্র পরিচয়। আমরা ভেন্ডরের [কাজের জোগানদার তৃতীয় পক্ষের ঠিকেদারেরা] থেকে কাজ পাই,” জানালেন তিনি।

পারসেল-পিছু ১২-১৪ টাকা কমিশন পান রমেশ, সুতরাং দিনভর ৪০-৪৫টা পারসেল বিলি করলে মেরেকেটে ৬০০ টাকা জোটে। কিন্তু, “জ্বালানির তেল, বিমা, ডাক্তারবদ্যি বা ওষধপত্রের খরচ, কোনও রকমের ভাতা — কিছুই পাই না আমরা।”

PHOTO • Amrutha Kosuru
PHOTO • Smita Khator

বাঁদিকে: শেখ সালাউদ্দিন, হায়দরাবাদ-কেন্দ্রিক একটি অ্যাপনির্ভর ট্যাক্সি সংস্থায় গাড়ি চালান। শেখার মধ্যে গাড়ি চালানোটাই সবচাইতে সহজ ছিল তাঁর কাছে, তাই এ পেশায় এসেছেন বলে জানালেন সালাউদ্দিন। ডানদিকে: বর্ষাকালে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মালপত্র বিলির কাজ

তিন বছর হল বিলাসপুরে নিজের বাড়ি ছেড়ে রায়পুরে আসার পর থেকে দিনরাত এক করে পরিশ্রম করছেন ২৪ বছরের সাগর কুমার, লক্ষ্য একটাই — দুমুঠো ভাত যাতে জোটে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা অবধি ছত্তিশগড়ের রাজধানীতে একটি অফিস বিল্ডিংয়ে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন তিনি, ছুটি হলে মাঝরাত পর্যন্ত স্যুইগির হয়ে খাবার বিলি করে বেড়ান বাইকে চেপে।

বেঙ্গালুরুর একটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁর বাইরে, মুঠোয় ধরা স্মার্টফোন নিয়ে এধার ওধার করছেন একাধিক বিলিকর্মী। কখন বিপ্-বিপ্ শব্দে পরবর্তী ওর্ডার আসবে তাঁর ফোনে, সে আশায় তীর্থের কাক হয়ে আছেন সুন্দর বাহাদুর বিশ্‌ত। অষ্টম শ্রেণির পর আর ইস্কুলে পড়া হয়নি, তাই সদ্য সদ্য শেখা ভাষায় অর্ডারের নির্দেশগুলি বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছিল তাঁকে।

“ইংরেজিতে পড়ি, টেনেটুনে বুঝে উঠি। এমনিতেও পড়ার মতো খুব একটা বেশি নেই... দোতলা, ১এ নম্বর ফ্ল্যাট...” অ্যাপ খুলে পড়ে শোনাচ্ছিলেন সুন্দর বাহাদুর। হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছেন, না আছে হাতে কোনও চুক্তিপত্র, তাঁর ‘অফিস’-টাও আক্ষরিক অর্থে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁর কথায়, “ছুটিছাটা, অসুখ-বিসুখে কামাই, এসবের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”

২০২২ সালে নীতি আয়োগ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলেছে: এদেশের মহাগর তথা ছোটো শহর মিলিয়ে শেখ, রমেশ, সাগর ও সুন্দরের মতন প্রায় ৭৭ লাখ গিগ (স্বল্পকালীন তথা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত) শ্রমিক কর্মরত।

PHOTO • Purusottam Thakur
PHOTO • Priti David

বাঁদিকে: বাড়তি রোজগারের আশায় বিলাসপুরে তাঁর ঘর ছেড়ে রাজধানীর রায়পুরে পাড়ি দিয়েছিলেন সাগর কুমার। ডানদিকে: বেঙ্গালুরু শহরে, অ্যাপের মাধ্যমে কেমন করে পরবর্তী ডেলিভারির ডাক পান, সেটা হাতেনাতে প্রদর্শন করছেন সুন্দর বাহাদুর বিশ্‌ত

ট্যাক্সি চালানো থেকে খাবার ও মালপত্র বিলি করা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে রূপচর্চার কাজও করেন এঁরা। গিগ শ্রমের সিংহভাগটাই যুবসমাজ দ্বারা গঠিত, স্মার্টফোনই তাঁদের কর্মক্ষেত্র। কাজের খুঁটিনাটি তৈরি করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন বট (bot), তথৈবচ কাজের নিরাপত্তা — হকিকতটা দিনমজুরদের মতোই। গত কয়েকমাসে, খরচা কমানোর অজুহাতে এমন হাজার হাজার গিগ শ্রমিকের রুজিরুটি ছিনিয়ে নিয়েছে এমনই দুই কোম্পানি।

পর্যায়ক্রমিক শ্রমিক সমীক্ষা (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২২) অনুসারে, ১৫-২৯ বছর বয়সি শ্রমিকদের মধ্যে ১৮.৫ শতাংশ কর্মহীন — ফলত গিগ শ্রমে আইনি তথা চুক্তি-সংক্রান্ত ফাঁকফোঁকর থাকা সত্ত্বেও কাজের খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাঁরা।

এতকিছুর পরেও তাঁরা শহুরে দুনিয়ায় অন্যান্য দিনমজুরি ছেড়ে গিগ শ্রমের দিকে ঝুঁকছেন কেন? “কুলিগিরি করেছি, তারপর জামাকাপড় আর ব্যাগের দোকানেও কাজ করেছি। কিন্তু স্যুইগির [ডেলিভারি] কাজে একখান মোটরবাইক আর ফোন থাকলেই কেল্লাফতে। ওজনদার মালপত্তর তোলা-পাড়া বা [শারীরিকভাবে] খুব কঠিন কিছু করতে হয় না,” জবাব দিলেন সাগর। রায়পুরে সন্ধ্যা ৬টার পর খাবারদাবার সহ বিভিন্ন জিনিস বিলি করে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা কামান তিনি, উৎসবের মরসুমে সেটা বেড়ে ৫০০ অবধি হয়ে যায়। ওঁর পরিচয়পত্রটি ২০৩৯ পর্যন্ত বৈধ ঠিকই, তবে না লেখা আছে রক্তের গ্রুপ না লেখা রয়েছে বিপদে-আপদে যোগাযোগ করা যায় এমন কারও তথ্য। এতকিছু হালনাগাদ করার মতো সময় হয়ে ওঠেনি বলে জানালেন সাগর।

তবে দিনের বেলায় নিরাপত্তা সংস্থার যে চাকরিটা তিনি করেন, সেখানে স্বাস্থ্যবিমা আর প্রভিডেন্ট ফান্ডও আছে, আবার বেতনটাও ১১,০০০ টাকা। এই চাকরি থেকে আসে স্থিতিশীলতা, আর বিলি করার গিগ শ্রম দিয়েছে খানিক উপরি রোজগার — ফলত অল্প অল্প করে সঞ্চয় করতেও সক্ষম হচ্ছেন সাগর। “টাকা জমানো, বাড়িতে টাকা পাঠানো আর করোনার সময় জমে ওঠা কর্জ চোকানো — মোটে একখান চাকরির জোরে এতকিছু করতে পারছিলাম না। সে যতই কম হোক না কেন, খানিক খানিক জমাতে তো পারছি এখন।”

PHOTO • Purusottam Thakur

সাগরের বক্তব্য, ‘সংসারের অনটন সামলাতে ক্লাস টেন অবধি পড়েই [বিলাসপুরে] ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম যে শহরে [রায়পুর] গিয়ে খেটে খাব’

সাগরের বাবা সাইরাম একটি স্টল পেতে সবজি বিক্রি করেন বিলাসপুরে, মা সুনীতার সময় কাটে কনিষ্ঠ দুই সন্তান, ভবেশ (৬) ও চরণের (১) দেখভাল করে। এই ছত্তিশগড়ী পরিবারটি একটি দলিত জাতির অন্তর্ভুক্ত। সাগরের বক্তব্য, “এমনই অভাবের সংসার যে ক্লাস টেনের পর আর পড়তে পারিনি। তখন কামধান্দার খোঁজে রায়পুরে যাব বলে ঠিক করি।”

হায়দরাবাদের অ্যাপ-ভিত্তিক ক্যাবচালক শেখ সালাউদ্দিন জানালেন, কাজের মধ্যে গাড়ি চালানোটাই সবচেয়ে সোজা বলে এটা শিখেছেন তিনি। তিনটি কন্যাসন্তানের এই পিতার থেকে জানতে পারলাম, কেমনভাবে তিনি সংগঠনের কাজ ও গাড়ি-চালানোর মাঝে দিনগুলো ভাগ করে নেন। তবে ট্যাক্সিটা সাধারণত রাতেই চালান, কারণ, “পথে গাড়িঘোড়াও কম, আর টাকাটাও খানিক বেশি।” সমস্ত খরচাপাতি মেটানোর পর মাস গেলে ১৫-১৮ হাজার টাকা রোজগার হয় তাঁর।

কলকাতায় চলে আসার পর, চটজলদি রোজগার শুরু করবেন বলেই অ্যাপ-ভিত্তিক ডেলিভারির কারবারে পা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন রমেশ। সাগরের মতো তিনিও সাংসারিক অনটনের তাড়নায় দশম শ্রেণির পর ইস্কুলছুট হয়ে পড়েন। বিগত দশবছরের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, “মাকে সাহায্য না করে উপায় ছিল না, তাই উপার্জন শুরু করতেই হত। এটাসেটা কামকাজ করতাম — যেমন ধরুন দোকানে ডেলিভারির কাজ।”

কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলে পার্সেল বিলি করতে বেরিয়ে ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়লেই মাথার মধ্যে জমতে থাকে উদ্বেগের চাপ। রমেশের কথায়: “সারাটাক্ষণ তাড়ায় থাকি। খ্যাপার মতন সাইকেল চালাই...সময়মতন করতেই হবে, হরদম এই চিন্তাটাই তাড়া করে ফেরে। আমাদের জন্য বর্ষাকালটাই সবচেয়ে খারাপ সময়। বিশ্রাম, খাবার, স্বাস্থ্য, সবকিছুই কোরবানি দিই টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে।” পিঠে ঝুলছে পার্সেল ঠাসা এক দৈত্যাকার ব্যাগ। “আমাদের প্রত্যেকেই চালানের এরকম ভারি ভারি মালপত্তর বই। পিঠ ব্যথায় ভোগে না, এমন বিলিকর্মী নেই। অথচ আমাদের কারও কোনও স্বাস্থ্য সুবিধা (বিমা এবং/কিংবা ভাতা] নেই,” বললেন তিনি।

PHOTO • Anirban Dey
PHOTO • Priti David

সুন্দরের (ডানদিকে) মতো এমন বিলি-কর্মী খুব কমই আছেন তাঁদের ছোটখাট পার্সেল বইতে হয়, রমেশের (বাঁয়ে) মতো বাদবাকিরা কাঁধে দৈত্যাকার সব ব্যাগ চাপিয়ে পিঠ ব্যথায় ভুগে মরেন

এই কাজের দুনিয়ায় পা রাখবেন বলে মাস চারেক আগে একটি স্কুটার কিনেছেন সুন্দর, যাতে বেঙ্গালুরুর এদিক-সেদিক যাতায়াত করতে সুবিধে হয়। তিনি জানালেন: মাস গেলে ২০-২৫ হাজার টাকা রোজগার করতেই পারেন, কিন্তু স্কুটারের কিস্তি (ইএমআই), জ্বালানির পেট্রোল, বাড়িভাড়া আর খাইখরচা মেটাতে গিয়ে ১৬,০০০ টাকা বেরিয়ে যায়।

দেশ তাঁর নেপালে, আট ভাইবোনের মধ্যে সব্বার ছোটো। বাড়ির সবাই হয় চাষি কিংবা দিনমজুর, ওঁর আগে কাজের সন্ধানে এভাবে তালুক-মুলুক সব ছেড়ে হাজার হাজার কিলোমিটার কেউই পাড়ি দেয়নি। “ধার করে জমি কিনেছিলাম, টাকাটা শোধ দিতে হবে, যতদিন না সেটা করতে পারছি ততদিন এই কাজটা করব,” জানালেন তিনি।

*****

“ম্যাডাম, আপনি আদৌ গাড়ি চালাতে জানেন তো?”

এই সওয়ালটা শুনে শুনে ঝালাপালা হয়ে গেছে শবনমবানু শেহাদালি শেখের কান। আহমেদাবাদের এই ২৬ বছর বয়সি মহিলা ট্যাক্সিচালকটি আজ চার বছরেরও বেশি সময় ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন, আজকাল এই জাতীয় লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক মন্তব্য এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দেন।

PHOTO • Umesh Solanki
PHOTO • Umesh Solanki

আহমেদাবাদের একটি অ্যাপ-ভিত্তিক ট্যাক্সি কোম্পানিতে কাজ করেন শবনমবানু শাহেদালি শেখ। শোহর মারা যাওয়ার পর একার রোজগারে মেয়েকে ইস্কুলে পড়াচ্ছেন, এ নিয়ে গর্বের শেষ নেই তাঁর

এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাঁর শোহরকে হারানোর পর শক্তহাতে স্টিয়ারিং ধরেছিলেন শবনমবানু। ফেলে আসা দিনের কথা মনে করে বললেন, “নিজে নিজে কক্ষনো রাস্তা পারাপার করিনি।” সিম্যুলেটরে হাত পাকিয়ে তবেই পথে নামেন এক সন্তানের এই মা। তারপর, ২০১৮ সালে একখান গাড়ি ভাড়া করে যোগ দেন একটি অ্যাপ-ভিত্তিক ট্যাক্সি পরিষেবায়।

মুচকি হেসে জানালেন, “আর আজ সেই আমি হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছি।”

বেকারত্ব বিষয়ক তথ্য বলছে, ২৪.৭ শতাংশ নারী কর্মহীন, অর্থাৎ পুরুষের চাইতে অনেকখানি বেশি। ব্যতিক্রমের দলে রয়েছেন শবনমবানুর মতো মহিলারা। ঘাম ঝরানো রোজগারে নিজের মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে পারছেন বলে গর্বের অন্ত নেই তাঁর।

লৈঙ্গিক চমকটা [যাত্রীদের] কেটেছে ঠিকই, তবে ২৬ বছরের এই মানুষটি আরও অনেক কিছু নিয়ে চিন্তিত। “রাস্তাঘাটে শৌচাগারের সংখ্যা বড্ড কম, একটার থেকে আরেকটা অনেক তফাতে। পেট্রোলপাম্পের টয়লেটগুলো তালাবন্ধ। ওখানে শুধু মরদরা কাজ করে, তাই মেয়ে হয়ে চাবি চাইতে বড্ড শরম হয়।” ভারতের গিগ অর্থনীতিতে মহিলা শ্রমিক নামের একটি গবেষণাপত্রে বলছে: হাতের নাগালে পর্যাপ্ত সংখ্যায় শৌচাগার তো নেই-ই, তার উপর লৈঙ্গিক মজুরি-বৈষম্য ও কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাবের সঙ্গেও মোকাবিলা করছেন মহিলারা।

PHOTO • Umesh Solanki

রাস্তাঘাটে অনেকদূর ছাড়া ছাড়া রয়েছে শৌচালয়, তাই প্রকৃতির ডাক এলে কাছেপিঠে কোথায় টয়লেট আছে তা জানতে গুগলের সাহায্য নেন শবনমবানু, তারপর অতিরিক্ত দু-তিন কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে পৌঁছন সেখানে

প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করা যখন আর সম্ভব হয়ে ওঠে না, শবনমবানু তখন গুগলের সাহায্যে খোঁজ লাগান নিকটবর্তী শৌচাগারের। তারপর অতিরিক্ত দু-তিন কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে পৌঁছন সেখানে। তাঁর কথায়: “উপায় একটাই, কম কম পানি খাওয়া। কিন্তু সেটা করলে রোদে-তাপে মাথা ভনভন করে। দুচোখে ঝুপ করে আঁধার নেমে আসে। তখন রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাধ্য হই খানিক ইন্তেজার করতে।”

কলকাতার এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানায় ছুটতে ছুটতে একই সমস্যার মোকাবিলা করেন রমেশ। “দৈনিক টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে এসব জিনিস [শৌচ-বিরতি] নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসতটুকুও মেলে না,” চিন্তিত শোনায় তাঁকে।

“ধরুন কোনও চালকের টয়লেট পেয়েছে, আর তক্ষুনি রাইড রিকোয়েস্ট (সওয়ারির ডিজিটাল অনুরোধ) এল তাঁর ফোনে, তখন সেটা ডিক্লাইন (মানা) করার আগে হাজারবার ভাবতে হবে তাঁকে,” জানালেন তেলেঙ্গানা গিগ ও প্লাটফর্ম মজদুর সংগঠনের (টিজিপিডাব্লিউইউ) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি শেখ সালাউদ্দিন। সওয়ারির অনুরোধ মানা করলেই চিত্তির! অ্যাপের মানসূচক রেটিংয়ে আপনি তলিয়ে যাবেন, জরিমানা বসবে, তার সঙ্গে চিরতের ঢ্যাঁড়া পড়ে যাওয়া বা সাইডলাইনড্ (এআই যখন সওয়ারির অনুরোধ আপনাকে পাঠায় না) হওয়াটাও আশ্চর্যের কিছু নয়। তখন বায়বীয় এক ডিজিটাল সত্তার কাছে টিকেট রেজ (অভিযোগ দাখিল) করে আশার বলে বুক বাঁধা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না আপনার কাছে।

এসডিজি ৮-এর জন্য ভারতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শিরোনামে একটি রিপোর্ট করেছে নীতি আয়োগ, সেখানে বলা আছে: “ভারতের শ্রমিকবলের প্রায় ৯২ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত...কাঙ্খিত সামাজিক নিরাপত্তা তাঁরা পান না...” অন্যান্য বেশ কিছু বিষয়ের পাশাপাশি “শ্রম-অধিকার সুরক্ষিত করা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ও নিশ্চিত পরিবেশের প্রচার,” করার লক্ষ্যে মনোনিবেশ করেছে রাষ্ট্রসংঘের অষ্টম নবায়নযোগ্য উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (সাস্টেনেবল্ ডেভেলপমেন্ট গোলস্)।

PHOTO • Amrutha Kosuru

তেলেঙ্গানা গিগ ও প্লাটফর্ম শ্রমিক সংগঠনের (টিজিপিডাব্লিউইউ) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি শেখ সালাউদ্দিন

২০২০ সালে সামাজিক নিরাপত্তা বিধি পাশ করানোর পর গিগ ও প্লাটফর্ম (ডিজিটাল মঞ্চ) কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা রূপায়িত করতে কেন্দ্র সরকারকে ডাক দিয়েছে আমাদের সংসদ। ধরা হচ্ছে, ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে উক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে ২ কোটি ৩৫ লক্ষে গিয়ে পৌঁছবে।

*****

এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় বহু শ্রমিকের কাছে গিয়েছিল পারি, ওঁদের অনেকেরই মধ্যে “মালিক [মনিব]”-হীন আজাদির অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছি আমরা। সুন্দর আগে বেঙ্গালুরুতে জামাকাপড় বেচতেন, তবে গতে-বাঁধা সেলসম্যান হওয়ার চেয়ে বর্তমানের কাজটা অনেক ভালো তাঁর মতে। “আমি নিজেই নিজের মনিব। নিজের সময়মতো কামকাজ করি, চাইলে এই মুহূর্তেই ছেড়ে দিতে পারি।” তবে হ্যাঁ, কর্জটা মিটলেই যে অপেক্ষাকৃত সুস্থির ও হালকা কাজ খুঁজবেন, সেটাও স্বীকার করলেন।

ত্রিপুরা থেকে আগত শম্ভুনাথের অবশ্য অত বকবক করার সময় নেই — পুণের একটি জনপ্রিয় ও ব্যস্ত রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি, খাবারের পার্সেল কখন আসবে তার অপেক্ষায় সারি দিয়ে মুখিয়ে আছেন জোম্যাটো ও স্যুইগির বাইক নিয়ে অপেক্ষারত বিলিকর্মীরা। গত চার বছর ধরে পুণেতেই বসবাস করছেন শম্ভুনাথ, কথা বলেন ঝরঝরে মারাঠিতে।

আগে একটি শপিং মলে কাজ করতেন, বেতন ছিল মাসিক ১৭,০০০ টাকা, তবে সুন্দরের মতো তাঁরও নতুন কাজটাই পছন্দ। “এই কাজটা বেশ ভালো। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছি, সবাই [ইয়ার-দোস্ত] মিলে একসঙ্গে থাকি। দিন গেলে হাজার টাকার মতো রোজগার হয়,” জানালেন শম্ভুনাথ।

PHOTO • Riya Behl
PHOTO • Riya Behl

অনায্যভাবে তাঁর রোজগারের একটা বড়ো অংশ হাতছাড়া হয়ে যাবে, তাই একটি অ্যাপ-ভিত্তিক সংস্থাকে মানা করে দিয়েছেন রুপালি কোলি। রূপচর্চার কাজ করে মা-বাবা, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সহায়তা করেন তিনি

প্রসাধন বিশারদ রুপালি কোলি যে চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছেন, এর জন্য দায়ী কোভিড-১৯ লকডাউন। তাঁর কথায়, “যে পার্লারটায় কাজ করতাম, ওরা মাইনে কেটে আধা করে দেয়, তাই ফ্রিল্যান্সিং করব বলে ঠিক করি।” প্রথমে ভেবেছিলেন একটি অ্যাপ-ভিত্তিক সংস্থার সঙ্গে জুড়বেন, কিন্তু অচিরেই মত পাল্টে ফেলেন। “খাটাখাটনি যদি সেই আমাকেই করতে হয়, মালপত্তর বওয়া থেকে যাতায়াতের খরচ যদি সেই নিজেরই গাঁটের থেকে বেরোয়, তাহলে অন্য কাউকে ৪০ শতাংশ দেব কেন? ঘাম ঝরাবো ১০০ ভাগ, কিন্তু হাতে পাব মোটে ৬০ ভাগ, এমনটা করা না-মুমকিন।”

৩২ বছর বয়সি রুপালি মুম্বইয়ের (আন্ধেরি তালুক) মাধ দ্বীপ-নিবাসী একটি মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান। স্বতন্ত্র রূপচর্চা থেকে যেটুকু রোজগার হয়, তা দিয়ে মা-বাবা, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাহায্য করেন, আর, “এভাবেই মাথার উপর ছাদ থেকে বিয়ে-শাদি, সবকিছুরই ইন্তেজাম করেছি নিজে নিজে,” বললেন রুপালি। তাঁর পরিবারটি কোলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত — মহারাষ্ট্রে যাঁদের নাম রয়েছে বিশেষ অনগ্রসর জাতির (এসবিসি) তালিকায়।

শহরের এই প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে আট কেজির ট্রলি টানতে টানতে ঘুরে বেড়ান তিনি, কাঁধে থাকে তিন কেজির আরেকটি ব্যাগ। পূর্বনির্ধারিত সময়ে খদ্দেরের বাড়ি পৌঁছে যান — তারই ফাঁকে ফাঁকে সংসার সামলান, তিনবেলা রান্নাও করেন বাড়ির লোকের জন্য। জোরগলায় জানালেন দিলেন রুপালি: “আপনা মন্ কা মালিক হোনে কা [নিজের মনের মালিক হতে হবে নিজেকেই]।”

হায়দরাবাদ থেকে অমৃতা কোসুরু , রায়পুর থেকে পুরুষোত্তম ঠাকুর , আহমেদাবাদ থেকে উমেশ সোলাঙ্কি , কলকাতা থেকে স্মিতা খাটোর , বেঙ্গালুরু থেকে প্রীতি ডেভিড , পুণে থেকে মেধা কালে এবং মুম্বই থেকে রিয়া বেহল মিলে এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন। সম্পাদকীয় সহায়তায় রয়েছেন মেধা কালে , প্রতিষ্ঠা পান্ডিয়া , জশুয়া বোধিনেত্র, সম্বিতি আইয়ার , রিয়া বেহল প্রীতি ডেভিড

প্রচ্ছদচিত্র: প্রীতি ডেভিড

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra