হন্যে হয়ে দুটি-পাতা-একটি-কুঁড়ি খুঁজে ফিরছেন রাজিন্দর। পাহাড়ের ঢালে ছবির মতো সাজানো চা-গাছের সারি, সবুজ শ্যামল পল্লবদল আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছিল রাজিন্দরের আঙুল। কাছেই একখান ঝুড়ি নিয়ে তৈরি হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী সুম্না দেবী। হিমালয়ের ধওলাধার পর্বতশ্রেণি, পাহাড়ের গাত্রদেশে ঘন চা-ঝোপ ও মানুষ — দুজনেরই মাথায় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যাকার ওহি গাছের দল।

আজ ফসল তোলার সময়, ত্রস্ত হাতে তন্নতন্ন করে পাতা ঢুঁড়েও রাজিন্দরের ঝুলি শূন্য। ফি দিন হয় সুমনা কিংবা তাঁদের ২০ বছরের ছেলে আরিয়ানকে সঙ্গী করে কাংড়া জেলার তান্ডা গাঁয়ের এই চা-বাগানে আসেন তিনি। এপ্রিল ও মে জুড়ে চলে চা-পাতা তোলার মরসুম, বাহারি নাম যার ফার্স্ট ফ্লাশ। কিন্তু, আজ রিক্ত হস্তেই রয়ে গেলেন মানুষটি।

“টের পাবেন তাপের বাড়বাড়ন্ত, বৃষ্টি যে কোথায় তা কেউ জানে না!” বললেন রাজিন্দর। হিমাচল প্রদেশের পালমপুর তেহসিলে শুকিয়ে যাওয়া চা-গাছ নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

গত দুবছর ধরে বৃষ্টিপাতের হার তলানিতে ঠেকেছে, সুতরাং রাজিন্দরের আশংকা মোটেই অমূলক নয়। ২০১৬ সালের একটি এফএও আন্তঃসরকারি রিপোর্টে বলেছে: “খাপছাড়া বৃষ্টিপাতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চা-বাগান।” চা-গাছ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বৃষ্টি না পেলে বিপদ, এই নিরিখে চায়ের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সংক্রান্ত গবেষণার কথা লেখা রয়েছে এই রিপোর্টটিতে। উক্ত সময়ের মধ্যে বৃষ্টি পেলে প্রথম ফসল ওঠে এপ্রিলে, যার দর সবচাইতে বেশি — ৮০০ টাকা কিলো, মাঝেমধ্যে তো কিলো-পিছু ১,২০০ টাকাতেও ঠেকে।

অতিরিক্ত দুই একর জমি ইজারায় নিয়েছিলেন রাজিন্দর, মুখিয়ে ছিলেন ২০২২ সালের জন্য: “ভেবেছিলাম রোজগারটা বাড়বে।” মোট তিন একর জমিতে চা-চাষ করেন, আশা ছিল মরসুমের শেষে ৪,০০০ কিলো চা তো পাবেনই। ইজারায় মূল্য ছিল ২০ হাজার টাকা। চা উৎপাদনে মোট যা খরচা হয়, তার ৭০ শতাংশই থাকে মজুরির ভাগে, জানালেন তিনি। “বাগিচার দেখভাল করতে বিশাল খাটাখাটনির দরকার, খরচাপাতিও [ইনপুট] বেশ চড়া।” উপরন্তু চা-পাতা প্রক্রিয়াকরণের (প্রসেসিং) উপরি খরচা তো আছেই।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

কচি কচি পাতার খোঁজে চা-গাছের ঝোপ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন রাজিন্দর। ডানদিক: পারিবারিক চা-বাগিচায় রাজিন্দর, তাঁর স্ত্রী সুম্না (ডানদিকে) ও ছেলে আরিয়ান (বাঁদিকে)

পরিবারটি লবানা জাতির অন্তর্গত, হিমাচল প্রদেশে এটি অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহের (ওবিসি) তালিকায় নিবন্ধিত। রাজিন্দরের কথায়: “[আমার পরিবারের] পূর্ববর্তী প্রজন্মও এই কাজ করত।” চার ভাইবোনের মধ্যে রাজিন্দরই সবার বড়ো। তাই বহুদিন রোগভোগ করার পর বাবা প্রয়াত হলে ১৫ বছর বয়সেই ইস্কুল-জীবনে ঢ্যাঁড়া কেটে পারিবারিক খামারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি।

পরিবারের সক্কলে মিলেই এই চা-বাগান এবং পানযোগ্য চা উৎপাদিত হওয়া অবধি প্রক্রিয়াকরণের যাবতীয় কাজ সামলান। মেয়ে আঁচল স্নাতক স্তরে পড়ে, একই সঙ্গে আগাছা নিড়ানো এবং প্যাকিংয়ের কাজও করে। ছেলে আরিয়ান তো আগাগোড়া পুরো প্রক্রিয়াটার সঙ্গেই যুক্ত — আগাছা নিড়ানো, চা-পাতা তোলা, ডালপালা কাটছাঁট করা থেকে প্যাকিং। ২০ বছরের এই যুবক গণিতে গ্র্যাজুয়েশন করার পাশাপাশি আংশিক সময়ের জন্য শিক্ষকতাও করছেন।

কালো ও সবুজ — স্থানীয় গেরস্থালিতে জনপ্রিয় দুই ধরনের চা-ই আসে কাংড়ার চা-বাগান থেকে। সুম্নার জবানে: “হাজার ঢুঁড়লে তবেই গিয়ে একটা চায়ের দোকান মেলে এখানে, অথচ যার বাড়িতেই যান না কেন, চা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে আপনাকে। চায়ে দুধ বা চিনি মেশাই না আমরা। আমাদের কাছে এটা ওষুধের মতন।” গ্রেডিং (গুণমান অনুযায়ী চা বাছাই করা) ও প্যাকিংয়ের কাজ করেন বলে জানালেন তিনি। প্রক্রিয়াকরণের জন্য ছোট্ট একখান অস্থায়ী কামরা ইস্তেমাল করেন রাজিন্দরের মতো চা-উৎপাদকেরা, যেখানে টাটকা পাতা পাকিয়ে গরম (রোল অ্যান্ড রোস্ট) করার যন্ত্রপাতি রাখা থাকে। তৈরি মালের জন্য কিলো-পিছু ২৫০ টাকা দিয়ে অন্যান্য চা-চাষিরাও নিজেদের বাগানের চা প্রসেস করিয়ে নেন এখান থেকে।

তাঁর পরিবার যাতে তাজা পাতার প্রক্রিয়াকরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সেজন্য ১৯৮৬-এ মারা যাওয়ার ঠিক আগে জমি বেচে ও কর্জ নিয়ে ৮ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কিনে রেখে গিয়েছিলেন রাজিন্দরের বাবা। এই ঋণ আজও বকেয়া রয়ে গেছে।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

চায়ের প্রক্রিয়াকরণে যে যন্ত্রাদি লাগে, বহু চাষির কাছে তা মজুত আছে। ভিটের বাইরেই একটি অস্থায়ী ঘরের ভিতর, নিজেদের মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রাজিন্দর (বাঁদিকে); এই ঘরটিকে ‘ফ্যাক্টরি’ বলেন তিনি। গুণমান অনুযায়ী চা বাছাই করা থেকে প্যাকিং, সবই করেন সুম্না (ডানদিকে)

কাংড়া জেলার চা-জগতে রাজিন্দরের মতো ক্ষুদ্র উৎপাদকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এঁদের ৯৬ শতাংশই দুই একরের কম জমির মালিক — একথা বলা আছে ২০২২ সালে রাজ্য কৃষি দফতরের প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে। আধা চা-বাগিচা রয়েছে পালমপুর তেহসিলে, বাকিগুলো ছড়িয়ে আছে বৈজনাথ, ধরমশালা ও দেহরা তেহসিল জুড়ে।

“হিমাচল প্রদেশের কেবলমাত্র খানকতক জেলাতেই চা চাষের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ চা গাছের জন্য ৪.৫-৫.৫ পিএইচ মাত্রাযুক্ত অম্লজাতীয় যে ধরনের মাটি দরকার, সেটা এখানে আছে,” ডঃ সুনীল পাটিয়াল জানালেন। ইনি রাজ্য কৃষি দফতরে কর্মরত টি টেকনিক্যাল অফিসার।

বলিউডের সিনেমায় ফিরে ফিরে আসে কাংড়ার চা-বাগান ও পার্বত্য সৌন্দর্য। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ অলৌকিক কান্ডকারখানা ঘিরে বানানো ‘ভূত পুলিশ’ নামে ছায়াছবিটি। “পর্যটকদের অনেকেই ঝপাঝপ ক্যামেরা বার করে আমাদের বাগিচার ছবি তোলে, কিন্তু আমাদের খোঁজখবর রাখে না বললেই চলে,” জানালেন রাজিন্দর।

*****

শূধমাত্র পার্বত্য বৃষ্টিপাতের (অরোগ্রাফিক প্রেসিপিটাটিভ্ রেইনফল) ভরসাতেই বেঁচে আছে হিমাচল প্রদেশের চা-বাগান — পারদ চড়লে সাধারণত বৃষ্টি নামে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে চা-গাছের দল। “তাপমাত্রা বাড়ছে, অথচ বৃষ্টি হচ্ছে না, এমনটা হলে খুবই মুশকিল। আর্দ্রতা ছাড়া চা-গাছ বাঁচে না, কিন্তু এখন [২০২১ ও ২০২২] যে বেজায় গরম,” বুঝিয়ে বললেন শ্রী পাটিয়াল।

ভারতীয় আবহাওয়া দফতর (আইএমডি) প্রদত্ত তথ্য অনুসারে ২০২২-এর মার্চ ও এপ্রিলে বৃষ্টিপাতের হারে ৯০ শতাংশ ঘাটতি সহ্য করেছে কাংড়া জেলা। ফলত, এপ্রিল-মে ২০২২-এ মোটে ১ লাখ কিলো চা-পাতা এসে পৌঁছয় পালমপুর সমবায় চা কারখানায় — এপ্রিল-মে ২০১৯-এ এর চারগুণ চা উৎপাদন হয়েছিল।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: এই বহুকাঙ্খিত ‘দুটি-পাতা-একটি-কুঁড়ি’ দিয়েই তৈরি হয় চা। ডানদিকে: চা তুলতে হাজির হন ভিনরাজ্যের শ্রমিকেরা

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

হিমাচল প্রদেশের কাংড়া জেলার পালমপুর সমবায় চা কারখানায় শুকোচ্ছে টাটকা তুলে আনা চা পাতা

রেহাই পাননি রাজিন্দরও। মে ২০২২-এর শেষের দিকে পারি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে যে কোনও মতে ১,০০০ কিলো চা-পাতা তিনি তুলতে পেরেছেন। এর অর্ধেকটা প্রক্রিয়াকরণের জন্য পালমপুর সমবায় চা কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, বাকিটা স্থানীয়ভাবে বেচবেন বলে বাড়িতেই প্রসেসিংয়ের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ছেলে আরিয়ানের কথায়, “চার কেজি কাঁচা পাতা থেকে এক কেজি চা মেলে। বেচব বলে প্রায় ১০০ খানা এক কেজির প্যাকেট বানাই আমরা।” ব্ল্যাক টি কিলো-পিছু ৩০০ টাকা এবং গ্রীন টি ৩৫০ টাকা কিলো দরে বিকোয়।

ভারতে উৎপাদিত চায়ের সিংহভাগটাই আসে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর নীলগিরি থেকে। ভারতীয় টি-বোর্ডের ওয়েবসাইটে লেখা আছে, ২০২১-২২ সালে ১৩৪ কোটি ৪০ লক্ষ কেজি চা উৎপাদন করেছিলাম আমরা, যার প্রায় ৫০ শতাংশই এসেছিল ক্ষুদ্র উৎপাদকদের থেকে। বাণিজ্য ও শিল্প কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের আওতায় থাকা এই প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য: “ক্ষুদ্র উৎপাদকেরা চূড়ান্ত অসংগঠিত, এঁদের জমিজমা খণ্ডিত তথা বিক্ষিপ্ত হওয়ায় মূল্য শৃঙ্খলে (ভ্যালু চেন) তাঁদের অবস্থান একেবারে তলায়।”

“অন্যান্য অঞ্চলের চায়ের সঙ্গে রেষারেষি করতে বাধ্য হয় হিমাচলের চা। উপরন্তু, রাজ্যের ভিতরের চিত্রটাও বেশ হতাশাজনক — আপেল-চাষিদের কদরও বেশি, আর [স্থানীয়] প্রশাসনের নেকনজরেও থাকেন তাঁরা,” বললেন ডঃ প্রমোদ বর্মা। পালমপুরের হিমাচল প্রদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চা-প্রযুক্তিবিদ তিনি, চা সংক্রান্ত গবেষণায় দশ বছরেরও বেশি সময় পার করেছেন।

ক্রমশ কমে আসছে চা-চাষের জমি, চা-উৎপাদনে চলতি মন্দার পিছনে এটিও একটি কারণ বটে। কাংড়া জেলায় ২,১১০ হেক্টর জমির উপর চা-গাছের ঝোপ লাগানো হয়েছে ঠিকই, তবে সক্রিয়ভাবে চাষ হচ্ছে এমন জমির আয়তন মোটে অর্ধেক — ১০৯৬.৮৩ হেক্টর। বাদবাকি হয় অবহেলিত, পরিত্যক্ত কিংবা রূপান্তরিত হয়েছে আবাসনে। এর শেষেরটি যদিও হিমাচল প্রদেশ সিলিং অন ল্যান্ড হোল্ডিংস্ আইন, ১৯৭২ -এর আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ, কারণ এই আইন অনুযায়ী চা-চাষের জমি বেচা বা অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যায় না।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

নিজেদের চা-বাগিচায় ঘাম ঝরান অশীতিপর জাট রাম ভামন ও তাঁর স্ত্রী অঞ্জোগ্য ভামন (ডানদিকে)। নিজের চা প্রসেসিংয়ের কর্মশালায় জাট রাম (বাঁদিকে)

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

বাঁদিকে: কাংড়া জেলার অসংখ্য চা-বাগান আজ পরিত্যক্ত। ডানদিকে: তান্ডা গাঁয়ে একখান চা-বাগিচা রয়েছে যশবন্ত ভামনের। তাঁর মনে পড়ে, এককালে স্থানীয় বাজারটা কেমন জমজমাট ছিল

তান্ডা গ্রামে রাজিন্দরের পড়শি জাট রাম ভামন জানালেন, “আমার খেতের ঠিক পিছনেই, কয়েকবছর আগেও চা-বাগিচা ছিল। এখন ঘরবাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না।” তিনি এবং তাঁর স্ত্রী অঞ্জোগ্য ভামন মিলে নিজেদের ১৫-ক্যানাল (আনুমানিক এক একরের তিন-চতুর্থাংশ) জমির উপর চা-চাষ করেন।

৮৭ বছরের জাট রাম আজও ভোলেননি সে দিনগুলোর কথা যখন চারিদিকে চা-বাগানের ছড়াছড়ি ছিল, এ চাষে মুনাফাও ছিল তখন। ১৮৪৯ সালে প্রথমবার চা-গাছের চারার রোপন করা হয় এখানে, ১৮৮০-এর দশক আসতে না আসতেই লন্ডন ও অ্যামস্টারডামের বাজারে একাধিক স্বর্ণ ও রৌপপদক জিততে শুরু করে কাংড়ার চা। ২০০৫ সালে তার একান্ত নিজস্ব স্বাদ ও গন্ধের জোরে ভৌগলিক শংসাপত্র (জিআই) লাভ করেছিল এখানকার চা।

“সোনালি বছর বলতে ওগুলোই ছিল, (সাবেক) মেশিনের সাহায্যে নিজেরাই ঘরে ঘরে চা-পাতা প্রসেস করে অমৃতসরে বেচতাম। বাজারটাও বিশাল ছিল,” তান্ডা গাঁয়ে ১০ ক্যানাল (মোটামুটি আধা একর) জমির চা-বাগানের মালিক, ৫৬ বছর বয়সি যশবন্ত ভামনের মনে পড়ে পুরোনো দিনের কথা।

ভামনের স্মৃতিচারণে যে সময়টা উঠে এল, সেটা ১৯৯০-এর দশক, স্থানীয় টি বোর্ডের তথ্য অনুসারে তখন বাৎসরিক ১৮ লাখ টন পানযোগ্য চা উৎপাদন করত কাংড়া। স্থলপথে ২০০ কিলোমিটার পেরিয়ে সে চা গিয়ে পৌঁছত অমৃতসরের বাজারে বাজারে — তারপর পালা আন্তর্জাতিক নিলামের। পরিমাণটা হ্রাস পেতে পেতে আজ আর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে — মোটে ৮,৫০,০০০ টন।

পারি-কে খানকতক পুরোনো রসিদ দেখিয়ে রাজিন্দর বলে উঠলেন, “ভালোরকম মুনাফা হতো [এক একরের চা-বাগিচা থেকে]। পানযোগ্য চা তৈরি হয়ে গেলে সারা বছর ধরে বারবার যাতায়াত করতে হতো। একেক দফা যাত্রায় ১৩,০০০-৩৫,০০০ টাকা আসত হাতে।”

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

কাংড়া জেলার ৯৬ শতাংশ চা-বাগানই আয়তনে দুই একরের চেয়ে কম। অর্ধেকের বেশি বাগিচা তো পালমপুর তেহসিলেই রয়েছে, বাদবাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বৈজনাথ, ধরমশালা ও দেহরা তেহসিল জুড়ে

সোনালি বছরগুলো ফিকে হতে অবশ্য খুব বেশিদিন লাগেনি। যশবন্তের কথায়, “অমৃতসর মেঁ বহত্ পাঙ্গা হোনে লাগা [অমৃতসরে বহুৎ ঝুটঝামেলা হতে লাগল]।” কাংড়ার চা-চাষিরা তখন একে একে কলকাতা, অর্থাৎ ভারতের মুখ্য নিলামকেন্দ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। নিজ নিজ বাড়িতে প্রক্রিয়াকরণের পাট চুকতে লাগল। চা-উৎপাদকেরা ধীরে ধীরে পালমপুর, বীর, বৈজনাথ ও সিধবাড়ির রাজ্যচালিত কারখানাগুলির স্মরণ নিলেন — যারা সরাসরি কলকাতার নিলামের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু, একে একে পড়ে যেতে থাকল এই সকল কারখানার ঝাঁপ, নিজেদেরই রাজ্যের সহায়তা হারালেন স্থানীয় চাষিরা। হারাধনের অন্তিম সন্তানের মতো কেবল একখানি সমবায় কারখানা পড়ে আছে আজ।

কলকাতার নিলামকেন্দ্র থেকে কাংড়ার দূরত্ব প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার। ফলত আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে রাহাখরচ, গুদামের ভাড়া ও মজুরি। ঠিক এই কারণেই আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও নীলগিরির চায়ের সঙ্গে মোকাবিলায় নেমে মুনাফা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে কাংড়ার।

“কাংড়ার চা রপ্তানি হয় বটে, কিন্তু কাংড়া চায়ের তকমা হটিয়ে সাঁটা হয় বিভিন্ন ক্রেতা ও বাণিজ্যিক সংস্থার নাম। কলকাতা খুবই সস্তায় এ চা কিনে চড়া দামে বিক্রি করে, রপ্তানিরও হয় দিব্যি,” বর্মা বোঝালেন।

*****

রাজিন্দর জানালেন, “বাগানের জন্য ওই ১,৪০০ কিলোর মতো সার দরকার, আর সেটা কিনতে প্রায় ২০,০০০ টাকা লাগবে।” আগে আগে রাজ্য সরকার থেকে সারের উপর ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হত বটে, কিন্তু ৫ বছর হতে চলল সেসব বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, ভর্তুকিটা কেন যে বন্ধ হয়েছে সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়, খোদ সরকারি দফতরও জানে না।

চায়ের মতো শ্রমনিবিড় ফসল খুব কমই আছে, চা-পাতা তোলার জন্য একদফা এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এবং ডালপালা ছাঁটার নভেম্বরের পর থেকে আরেক দফা প্রয়োজন পড়ে খেতমজুরের। রাজ্য সরকার ডালপালা ছাঁটার যন্ত্র দিয়েছে, মজুরি বাঁচাতে রাজিন্দর ও তাঁর ছেলে সেটা ব্যবহার করেন ঠিকই, কিন্তু পেট্রোলের পিছনে এককাঁড়ি টাকা খসে যায়।

PHOTO • Aakanksha
PHOTO • Aakanksha

কাংড়া জেলার তান্ডা গাঁ, সুম্না ও রাজিন্দরের ‘ফ্যাক্টরি’-তে চা প্রক্রিয়াকরণের যন্ত্রাদি

গতবছর এই পরিবারটি দৈনিক ৩০০ টাকার মজুরিতে তিনজন শ্রমিক বহাল করেছিল, “কিন্তু তোলার মতো কোনও পাতাই তো ছিল না, তাহলে আর ওদের [খেতমজুর] ধরে রেখে কী করতাম? মজুরিই বা মেটাতাম কোত্থেকে?” শ্রমিকদের কেন ছুটি দিয়েছিলেন, সেটা বোঝাতে গিয়ে বললেন রাজিন্দর। এপ্রিল থেকে অক্টোবর যখন ফসলের মরসুম চলে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মজুরে মজুরে ছয়লাপ হয়ে থাকার কথা — অথচ ২০২২ সালে হাজার খুঁজেও কাউকে দেখা যায়নি কোত্থাও।

ক্রমহ্রাসমান মুনাফা ও সরকারি অসহায়তার ফলে উঠতি প্রজন্ম ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এ তল্লাট থেকে, তারা যে কোনও ভবিষ্যৎই আর দেখতে পাচ্ছে না এখানে। জাট রাম জানালেন যে তাঁর সব সন্তানই সরকারি চাকরিতে বহাল আছেন। “আমরা চোখ বুজলে এসব [চা-বাগিচা] যে কে দেখবে, তা জানি না,” বললেন অঞ্জোগ্য।

রাজিন্দরের পুত্র আরিয়ানও এখানে পড়ে থাকতে ইচ্ছুক নন। “পেট চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠতে দেখেছি ওঁদের [মা-বাবা]। আপাতত বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করছি বটে, কিন্তু পরবর্তীতে এসব করব না,” জানালেন আরিয়ান।

রাজিন্দরের আন্দাজ, বছর শেষ হতে হতে ২.৫ লাখ টাকার মতো রোজগার হবে — বেশিরভাগটাই হবে অক্টোবরে, অর্থাৎ চায়ের মরসুমের শেষে। তারপর এই আড়াই লাখ থেকে একে একে বাদ যাবে ভাড়া, চাষের খরচা ইত্যাদি।

২০২২-এ শুধুমাত্র জমানো টাকার জোরে পেট চালানো সম্ভব হয়নি পরিবারের পক্ষে, জানালেন রাজিন্দর। বাড়ির গরুদুটোর দুধ বেচে, অন্য লোকের [অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র] বাগানের চা প্রসেস করে এবং আরিয়ানের শিক্ষকতার কাজ থেকে আসা ৫,০০০ টাকার ভরসায় কোনওমতে সংসার চলেছিল।

কারবারের অবস্থা এতটাই বেহাল যে ইজারায় নেওয়া দুই একর বাগিচা ২০২২ সালেই ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন সুম্না ও রাজিন্দর।

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র

Aakanksha

Aakanksha (she uses only her first name) is a Reporter and Content Editor at the People’s Archive of Rural India.

Other stories by Aakanksha
Editor : Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. A journalist and teacher, she also heads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum, and with young people to document the issues of our times.

Other stories by Priti David
Translator : Joshua Bodhinetra

Joshua Bodhinetra has an MPhil in Comparative Literature from Jadavpur University, Kolkata. He is a translator for PARI, and a poet, art-writer, art-critic and social activist.

Other stories by Joshua Bodhinetra