ব্রিটিশদের তৈরি ‘সেলুলার জেলে’র ভয়ঙ্কর অজানা কাহিনি, কীভাবে অত্যাচারিত হত বন্দিরা, তা জেনে নিন

সেলুলার জেলের অপর নাম 'কালাপানি’। ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত এই কারাগার। আজ থেকে বহু বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছিল। সালটা ছিল ১৯০৬! সে সময় ব্রিটিশরা দেশকে শাসন করতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু আগে থেকেই আন্দামানে ব্রিটিশদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল এই কালাপানি বা সেলুলার জেল। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তারের পর তাদের পাঠানো হতো এই কারাগারেই। তবে এই কারাগারটি কিন্তু ভয়ংকর অন্ধকূপের মতন। যা দেখলে অনেকের গাঁ শিউরে উঠবে। সে সময় আন্দামানে তেমন কেউ ভ্রমণ করতে যেত না, আর সেসময় সরকার দ্বারা সেখানে ঘুরতে যাওয়ার তখন কোনও অনুমোদনও পাওয়া যেত না। এই জেলে যারা বন্দি থাকতো যেসব কয়েদিরা নিজের জীবনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচত। প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা মুহূর্ত তাদের কাছে খুব ভয়াবহ ছিল। কিন্তু কেন কবেই বা এই জেল তৈরি হয়েছিল। কেনই বা আজও এই সেলুলার জেলের কথা শুনলে দেশবাসী এত ভয় পেয়ে যান, জানেন আপনি।

কত সালে তৈরি হয়েছেল এই জেল

স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিশেষ অংশ হয়ে উঠেছিল এই সেলুলার জেল। ১৮৯৩ সালে শুরু হয়েছিল এই জেল তৈরির কাজ তা শেষ হয়েছিল ১৯০৬ সালে । স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ এবং সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রায় ২০০ জন বিদ্রোহীকে আন্দামান দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। বলা হয় ১৮৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বীপগুলিকে পরিদর্শন করেছিলেন তারা। ১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকার একটি প্রতিবেদনও জমা দেন। সে সময় সরকার আন্দামান দ্বীপকে কারাগার বা জেল হিসাবে ব্যবহার করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম ১০ মার্চ ২০০ জন বিদ্রোহীকে এখানে আনা হয়েছিল।

বহু বিদ্রোহীকে এই জেলে রাখা হতো

উনিশ শতকে যখন ভারত পরাধীন ঠিক সে সময় স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল তুঙ্গে। অনেক বিদ্রোহীদের ফাঁসি তো দেওয়া হতোই, আবার অনেকের ঠাঁই হত সেই ভয়ংকর দ্বীপে। তখন ব্রিটিশ সরকার ভাবলেন এবার আন্দামানের দরকার এক নিরাপত্তা সমেত একটি কারাগার। তখনই নির্মিত হয়েছিল এই কালাপানি বা সেলুলার জেল। সে সময় বহু বিদ্রোহীকে এই কারাগারে রাখা হতো। ব্রিটিশ রাজকর্মচারী চার্লস জেমস ল্যাল এবং চিকিৎসক এ এস লেথব্রিজের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি কমিটি ১৮৯০ সালে পোর্ট ব্লেয়ার পরিদর্শন করেন এবং পোর্ট ব্লেয়ারের কাছে নির্মিত হয়েছিল এই কারাগার। বর্মা থেকে লাল রঙের ইট এনে প্রথম তৈরি হয়েছিল এই কারাগার।

আলাদা রাখা হতো বন্দিদের

এই সেলুলার জেলে বিশাল তিন তলার কাঠামো ছিল। সেখানে ভবনের সাতটি শাখা ছিল। কেন্দ্রে ছিল টাওয়ার। যেখান থেকে কারাগারের নিরাপত্তারক্ষীরা সকলের উপর নজরদারি রাখতেন। পেন্সিল ভ্যানিয়া সিস্টেম বা পৃথক সিস্টেম যেটিকে বলে, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল এই সেলুলার জেল। জেল যাতে একজন বন্দী থেকে অপর আরেকজন বন্দি আলাদা থাকতে পারে।

কক্ষগুলির উচ্চতা কত ছিল


সেলুলার জেলের প্রতিটি কক্ষই ১৪.৯ ফুট x ৮.৯ ফুট উচ্চতার ছিল। মানে ৩ মিটার উচ্চতা বলা চলে। প্রত্যক থাকত মাত্র একটি করে ঘুলঘুলি। যেটা মেঝে থেকে ৯.৮ ফিট উচুতে অবস্থিত। একটি বিশেষ ডিজাইন করা লোহার গিল করা দরজা থাকত। এই ছোট ঘরে কয়েদিদের বন্দি থাকার কারণে এর নাম দেওয়া হয়েছিল সেলুলার জেল। কক্ষগুলি এমন ভাবে বানানো হতো যাতে কোন বন্দি কারোর মুখ পর্যন্ত দেখতে না পান। তাঁদের যোগাযোগের উপায় পর্যন্ত ছিল। বন্দিদের বন্দি অবস্থায় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল বিভীষিকাময়।

কী কী দিয়ে তৈরি হয়েছিল কালাপানি

এটি তৈরি হয়েছিল আন্দামানের কুড়ি হাজার পাথর এবং ত্রিশ লক্ষ ইট ব্যবহার করে। এখানে লোহার গিল, চেন, শেকল চাবুকের স্ট্যান্ড, তেলকলের মতন সরঞ্জাম গুলি সব ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। যে সকল বন্দিকে সেলুলার জেলে পাঠানো হতো তাদের ওপর চলত অমানবিক ও নির্যাতন। সেই অত্যাচার অনেকেই সহ্য করতে পারতেন না। তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। গলায় লোহার রিং পায়ে লোহার শিকল বেঁধে তাদের উপর নির্যাতন করা হতো। তার ওপর তাদেরকে লাঠি দিয়ে মারা হতো। সেখানে ছিল ফাঁসির কক্ষ l কোন বাথরুমের সুবিধা ছিল না বন্দিদের। খাবার দেওয়া হতো খুব খারাপ, অস্বাস্থ্যকর। কোন কোন বন্দীকে কখনো হাতেকড়া পড়িয়ে ৬ মাসের জন্য বেঁধে রাখা হতো। নির্জন কারাগারে এভাবেই পড়ে থাকত কত বন্দি তা অনেকেরই অজানা।

বন্দিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের নাম

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বহু আন্দোলনকারী যেমন বটুকেশ্বর দত্ত, উল্লাস কর, বিনায়ক দামোদর সাভারকর কে, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, হরে কৃষ্ণ কোনার, ভাই পরানন্দ সিং, সুবোধ রায়, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে এই কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য বন্দিদের মধ্যে তারাও একজন।

বন্দিরা গন অনশন করত

সকল বন্দি খুব অত্যাচারিত হতো। জেলের কর্মীরা তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিত। যখন সেই সব বন্দি তাদের উপরেই নির্যাতিত অত্যাচার আর সহ্য করতে পারত না তারা জেল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করত, গণ অনশন ধর্মঘট করত। বিশেষ করে ১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ সালে এই ঘটনাটি বেশি ঘটেছিল।

১৯৩৭ সালের জুলাই মাসের শুরু হয়েছিল শেষ ধর্মঘট চলেছিল। ৪৫ দিন চলেছিল। সে সময় সরকার এমন ব্যবস্থা বন্ধ অনেক ব্যবস্থা করে। ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসের এই সেলুলার জেলের সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের তাদের নিজ নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়। ১৯৩৯ সালে এই জেল খালি করতে বাধ্য করা হয়।

কোথায় হয়েছিল পতাকা উত্তোলন

তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এসময় জাপানি সেনাবাহিনী আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে করেন। ১৯৪৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর জার্মান দ্বীপপুঞ্জে কিছু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাহিন্দ সরকারকে দেওয়া হয়। যা মুক্ত ভারতের অস্থায়ী সরকার নামেও পরিচিত। পোর্ট প্লেয়ার পরিদর্শন করেন। ১৯৪৩ সালে ৩০ ডিসেম্বর আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের জিমখানা পতাকা উত্তোলন করা হয়।

১৯৪১ সালে ভূমিকম্পের সময় ক্ষতির মুখে পড়ে এই কারাগার। মূল সাতটি ভবনের মধ্যে চারটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর পোর্ট ব্লেয়ারের জিমখানা গ্রাউন্ডে পতাকা উত্তোলন করা হয়।

সেখানে হাসপাতাল ছিল

সেলুলার জেলটি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সেই সময়ের মোরারজি দেশাই ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে জাতীয় এটি স্মৃতিসৌধ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেখানে ১৯৪৩৬ সালে সেলুলার জেলে গোবিন্দ বল্লভ পন্থ হাসপাতাল স্থাপিত করেছিলেন। যেখানে ৫০০ টি বেড ছিল এবং ৪০ জন ডাক্তার স্থানীয় জনগণকে সেবা দিত। যেটি আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসনের সুরক্ষার অধীনে ছিল। সেলুলার জেলে তিনটি শাখা এতটাই ভয়ংকর যা দেখলে গা শিউরে ওঠে অনেকেই। স্বাধীনতার সংগ্রামের আন্দোলনকে দমন করার জন্য বন্দীদের ওপর কী নির্মম অত্যাচার করা হয়েছিল তা আজও অনেকের চোখে জল এনে দেবে।

জেল ছাড়াও এখানে কী কী রয়েছে

সেলুলার জেলের প্রাঙ্গণে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা এবং সন্ধ্যা ৭.১৫ মিনিটে সাউন্ড-এন্ড-লাইট-শোতে বন্দিদের নির্যাতনের কাহিনী দেখানো হয়। এছাড়াও এখানে একটি জাদুঘর, একটি আর্ট গ্যালারি এবং একটি ফটো গ্যালারি রয়েছে। সোমবার ছাড়া সপ্তাহের সবদিন সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১২ টা এবং দুপুর ২ টো থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

ইতিহাসের অজানা পাতায় বঙ্গবীর অতুল চন্দ্র ঘোষ, এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবন যুদ্ধ ইতিহাসের অজানা পাতায় বঙ্গবীর অতুল চন্দ্র ঘোষ, এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবন যুদ্ধ

More INDIA News  

Read more about:
English summary
unknown facts about cellular jail do you know