কমনওয়েলথ গেমসে শ্রীশঙ্করের রুপো জয়ের নেপথ্যে অ্যাথলিট-পরিবারের অনুশাসন, ডাক্তারি পড়েননি লং জাম্পের জন্য

কমনওয়েলথ গেমসে ঐতিহাসিক রুপো জিতেছেন মুরলী শ্রীশঙ্কর। গেমসের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় পুরুষ লং জাম্পার হিসেবে। সোনাজয়ীর মতো ৮.০৮ মিটারের সেরা লাফ দিলেও গেমসের নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় সেরা লাফে একটু পিছিয়ে যাওয়ায় অধরা থাকল সোনা। তাতে অবশ্য আক্ষেপ নেই শ্রীশঙ্করের। কেরলের অ্যাথলিট পরিবার থেকে উঠে আসা শ্রীশঙ্কর নিজের বড় লক্ষ্য স্থির করেছেন প্যারিস অলিম্পিককেই।

রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল

লং জাম্পের ফাইনাল বেশ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে পৌঁছে গিয়েছিল। তৃতীয় প্রয়াসে ৭.৮৪ মিটারের লাফে তিনি নেমে গিয়েছিলেন ষষ্ঠ স্থানে। চতুর্থ প্রয়াসটি ফাউল হয়, নতুন টেকনোলজিতে যা ধরা পড়ে। এখনও এক বছরও হয়নি সেই প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। ফলে পদক জিততে শ্রীশঙ্করের কাছে ছিল মাত্র দুটি জাম্প। সাইডলাইনের ধারে থাকা বাবা তথা কোচ এস মুরলীর কথা শুনে পারফেক্ট ৮.০৮ জাম্প দেন শ্রীশঙ্কর। যা তাঁর রুপো নিশ্চিত করে। সদাহাস্যময় শ্রীশঙ্কর বলেন, দীর্ঘ সময় ধরেই বিশ্ব মিটে এমন ধরনের পদকের অপেক্ষা করছিলাম। বিশ্ব ইনডোর ও আউটডোর মিটে সপ্তম হয়েছি, বিশ্ব জুনিয়রে ষষ্ঠ হয়েছি, এশিয়ান ইনডোরে হয়েছি চতুর্থ, এশিয়ান গেমসে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছি। ফলে এখানে রুপো জিততে পেরে আমি খুশি। বারবার পদকের প্রত্যাশা করেও তা নিশ্চিত করতে পারিনি এতদিন। প্যারিস অলিম্পিকে পদক জয়ের লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করছি। এই পদক সেই লক্ষ্য়ের নিরিখে একটি ছোট পদক্ষেপ।

ঐতিহাসিক রুপো

শ্রীশঙ্কর বলেছেন, প্রত্যেক অ্যাথলিটকেই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। বর্তমানে যিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন সেই মিলটিয়াডিস টেনটোগলো আমাকে গ্রিসে বলেছেন তিনি ৭-৬-৪ হয়ে ক্রমাগত উঠে এসেছেন। এরপর তিনি টোকিও অলিম্পিকে পদক জিতেছেন। ফলে এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শেষ জাম্পটি নিতে গিয়ে তিনি ৮.১০ মিটার অতিক্রম করতে পারবেন বলেও ভেবেছিলেন শ্রীশঙ্কর। তাহলে সোনাই জিততেন। কিন্তু লাফ দেওয়ার সময় সামান্য সমস্যার কারণে সেটি হয়নি। ১৯৭৮ সালে পুরুষদের লং জাম্পে শেষবার ভারত পদক জিতেছিল। সেবার ব্রোঞ্জ জেতেন সুরেশ বাবু। মহিলাদের লং জাম্পে দেশকে কমনওয়েলথ গেমস থেকে প্রথম ব্রোঞ্জ এনে দেন অঞ্জু ববি জর্জ, ২০০২ সালের ম্যানচেস্টার গেমস থেকে। ২০১০ সালে দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে মহিলাদের লং জাম্পে রুপো জেতেন এমএ প্রযুশা।

বাবা যখন কোচ

শ্রীশঙ্করের বাবা তাঁর কোচ। শ্রীশঙ্করকে তিনি সাইডলাইনের ধার থেকে বলতে থাকেন, তুমি আগেও পেরেছো, এবারও পারবে। উল্লেখ্য, গত জুনে জাতীয় আন্তঃ রাজ্য অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীশঙ্কর মিট রেকর্ড গড়ার আগে সাব-সেভেন জাম্পে দাঁড়িয়ে ছিলেনয পঞ্চম প্রয়াসে ৮.২৩ মিটারের লাফ তাঁকে কমনওয়েলথ গেমসের ছা়ড়পত্র এনে দেয়। তবে বার্মিংহ্যামে রাত ৯টা নাগাদ খুব হাওয়া দিচ্ছিল। তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফলে শ্রীশঙ্কের এবারের কীর্তি গড়া কঠিন পরিস্থিতিতেই। একটা ভালো জাম্পেই শীর্ষে ওঠার হাতছানি ছিল। সেটাই ছিল অনুপ্রেরণা। শ্রীশঙ্কর বলেন, আমি পজিশন নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না। পঞ্চম বা ষষ্ঠ হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ হতো। সেটা আমি নিশ্চিত করতে পারব সেই বিশ্বাস ছিল। তবে শেষের দিকে টেকনিক-সহ সব কিছু ঠিকঠাক রেখে সোনা জয়ের সুযোগ থাকায় সেই লক্ষ্যেই ঝাঁপাই। দেশ-বিদেশে নানা ইভেন্টে অংশগ্রহণ তাঁর কমনওয়েলথ গেমসের পারফরম্যান্সে ইতিবাচক ভূমিকা নেয় বলেই জানিয়েছেন শ্রীশঙ্কর। তাঁর ব্যক্তিগত সেরা জাম্প অবশ্য ৮.৩৬ মিটারের।

চার বছরের ব্যবধান

২০১৮ সালে অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচারের কারণে কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নিতে পারেননি। এক সপ্তাহ ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকতে হয়েছিল। তারপর চলে দীর্ঘ রিহ্যাব প্রক্রিয়া। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া ট্র্যাকে ফিরতে পাঁচ-ছয় মাস লেগেছিল। তবে এবার গেমসে অভিষেকেই জিতলেন রুপো। অবশ্য শ্রীশঙ্কর উচ্ছ্বাসে ভাসতে নারাজ। মোনাকো ডায়মন্ড লিগ ও বুদাপেস্টে আগামী বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো ফল করাই তাঁর লক্ষ্য। ঈশ্বর ও বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শ্রীশঙ্কর। নীরজ চোপড়াও যেভাবে তাঁকে উৎসাহিত করেছেন তাতে তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ভারতের এই বছর তেইশের অ্যাথলিট।

অ্যাথলিট পরিবার

শ্রীশঙ্করের বাড়ি কেরলের পলক্কড় জেলায়। পুরো পরিবারই অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে যুক্ত। বাবা ছিলেন অ্যাথলিট, এখন তাঁর কোচ। দক্ষিণ এশিয়ান গেমস থেকে ট্রিপল জাম্পে পদক জিতেছিলেন তিনি। মা কেএস বিজমোল ১৯৯২ সালে এশীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ৮০০ মিটারের দৌড়ে রুপো জিতেছিলেন। শ্রীশঙ্করের বোন শ্রীপার্বতী হেপ্টাথলনিস্ট। ছোট থেকেই বাবার হাত ধরে শ্রীশঙ্কর অনুশীলনে যেতেন। দৌড়ের পাশাপাশি অ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনুশীলন চলতো বাবার প্রশিক্ষণেই। কেরলের হয়ে অনূর্ধ্ব ১০ চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ মিটার ও ১০০ মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ন হন শ্রীশঙ্কর। ১৩ বছর বয়স থেকে জোর দেন ট্রিপল জাম্পে। পরে লং জাম্পে।

কড়া অনুশাসন

পরিবারের কঠোর অনুশাসনে বড় হয়েছেন শ্রীশঙ্কর। তাঁকে ট্রেনিংয়ের সময় গান শুনতে দেওয়া হতো না। সময় নষ্ট হয় এমন কিছুই করতে দেওয়া হতো না। ১৮ বছর হওয়ার পর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারের অনুমতি মেলে। এখনও শ্রীশঙ্করদের বাড়িতে রাত ১১টার পর টিভি চলে না। ক্লাস টেন ও টুয়েলভে ৯৫ শতাংশ নম্বর পাওয়া শ্রীশঙ্কর নিট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু লং জাম্পের কেরিয়ারের কথা ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েও তা ছেড়ে দেন। বেছে নেন অঙ্কে বিএসসি করাকে। ধূমপান বা মদ্যপান হচ্ছে এমন কোনও পার্টিতেও বন্ধুদের সঙ্গে যান না শ্রীশঙ্কর। শ্রীশঙ্কর নিজে বন্ধুদের কোনও পার্টিতে আমন্ত্রণ জানালে সেখানে শুধুই ফলের রস থাকে।

More COMMONWEALTH GAMES News  

Read more about:
English summary
Commonwealth Games 2022: Murali Shreeshankar Says Silver Is A Small Step Towards Big Goal In Paris Olympics. Kerela's Shreeshankar Comes From Athletics Family, Father Is His Coach.
Story first published: Friday, August 5, 2022, 15:09 [IST]