বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিণাম কী? দেশ কি বড় বিপদের সম্মুখীন?

By: Piya Saha

April 30, 2022

Share

বিদ্যুতের রেকর্ড চাহিদা। অন্যদিকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির কয়লাও এসে থেকে ঠেকেছে তলানিতে। ফলে, দেশজুড়ে বিভিন্ন জোনে ৭৫৩টি যাত্রাবাহী ট্রেন আপাতত বাতিল করল কেন্দ্র। রাজধানীতে মজুত রয়েছে মাত্র একদিনের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লা। দিল্লি সরকার জানিয়েছে, এই অবস্থা চললে দিল্লি মেট্রো বা হাসপাতালের মতো জরুরি পরিষেবা বন্ধ রাখতে হবে। পাঞ্জাবে লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎমন্ত্রী হরভজন সিংয়ের বাড়ির সামনে প্রতিবাদ দেখিয়েছেন কৃষকরা। বিদ্যুতের সংকটের মুহূর্তে প্রশ্ন জাগে, তবে কি বিজ্ঞানীদের আশঙ্কাই সঠিক? ফুরিয়ে এসেছে পৃথিবীর কয়লার ভান্ডার? না কি দেশজুড়ে বিদ্যুতের সংকটের নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও কারণ? রইল বিস্তারিত তথ্য।

বিদ্যুৎ সংকটের কারণ কী?

ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি-ব্যয়কারী দেশ। আর এই শক্তির অধিকাংশই উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। তাছাড়া বছরের এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকায় কয়লাও বেশি লাগে। শুধু ভারতে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে সেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়না। কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আমদানি ধাক্কা খেয়েছে। অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাহিদার মূল কারণ রেকর্ড পরিমাণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি।

উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা হাফ সেঞ্চুরির দোরগোড়ায়। গতকাল প্রয়াগরাজের তাপমাত্রা ছিল ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গতকাল দুপুর পর্যন্ত দেশের বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২ লক্ষ ৭ হাজার ১১১ মেগাওয়াট, যা সর্বকালীন রেকর্ড। সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি-র দৈনিক রিপোর্ট বলছে, দেশের ১৬৫টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৫৬টিতে কয়লার মজুত ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। অন্তত ২৬টিতে এই মজুতের পরিমাণ পাঁচ শতাংশেরও কম।
রাজধানীর ২৫-৩০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় দাদরি-২ এবং উঞ্চহার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। দু’টির কোনওটিতেই এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত কয়লা মজুত নেই। উত্তরপ্রদেশেও কয়লা মজুতের পরিমাণ ২৬ শতাংশে ঠেকেছে। হরিয়ানা, গুজরাত, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ- এই রাজ্যগুলিতে বিদ্যুৎ সংকট শোচনীয় রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্যে বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।
এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির জন্য ২ কোটি ১৫ লক্ষ টন কয়লার সঞ্চয় আছে আমাদের। সাত-দশ দিন নিশ্চিন্তে চলে যাবে। ভয়ের কোনও কারণ নেই । রোজ নতুন করে কয়লার ভাঁড়ার পূরণ করার কাজও চলছে। কিন্তু প্রশ্ন, এর ভবিষ্যত কী?
‘অল ইন্ডিয়া পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ার্স ফেডারেশন’ বিবৃতি দিয়ে বলেছে, কয়লা, রেল এবং বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সমন্বয়ের অভাবের ফল এই বিদ্যুতের সংকট দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন: হু হু করে বাড়ছে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা, অবসরের পরেও চাই কাজ
একটি রিপোর্ট বলছে, এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ওপর নির্ভরশীল রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম ছত্তিশগড় (৯১%)। দিল্লি ( ৮৬%) , পশ্চিমবঙ্গ ( ৮২%), উত্তরপ্রদেশ (৭২%) এবং মহারাষ্ট্র (৬৬%) কয়লার ওপর নির্ভরশীল।

ভবিষ্যৎ

বিদ্যুতের চাহিদা বছর বছর যে হারে বাড়ছে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় একমাত্র ভরসা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎসগুলি। এক্ষেত্রে দেশের মধ্যে কর্নাটক পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিতে পারে। তথ্য বলছে, রাজ্যের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের ৫২% তৈরি হয় পূরণযোগ্য শক্তির উৎস থেকে। বাকি ৩৪% শক্তির চাহিদা মেটায় থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলি, হাইড্রো এবং নিউক্লিয়ার প্লান্ট থেকে যথাক্রমে ১২% ও ৩% বিদ্যুৎ তৈরি হয়। ফলে রাজ্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের জোগান দিতে কোনও সমস্যা নেই।
২০২২ সালের মার্চ মাস অবধি দেশে ১১০ গিগাওয়াট শক্তির উৎপাদন সক্ষম হয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর স্থির করা লক্ষ্যের মাত্র ৬৩%। কিন্তু দেশের সর্বত্র যে সমানভাবে কাজ হয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ‘এমবার’ নামক সংস্থার রিপোর্ট। রিপোর্টে রয়েছে, দেশের মাত্র চারটি রাজ্য, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, কর্নাটক এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেই স্থির লক্ষ্যের তিন চতুর্থাংশ কাজ এগিয়েছে। এরপর উত্তরাখণ্ড ও সিকিম রাজ্যেই কাজ হয়েছে অর্ধেকের বেশি। অথচ মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো বেশি চাহিদাসম্পন্ন রাজ্যগুলিতে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক কাজও এগোয়নি।

এই অবস্থায় লক্ষ্যপূরণের সময় ২০২২ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ করা হয়েছে। লক্ষ্য অনুযায়ী, ভারত এই দশকের শেষে ৪৫০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন করবে। অর্থাৎ, প্রতি বছর গড়ে ৪২.৫ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। লক্ষ্যপূরণের স্বার্থে এই আট বছরে বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঁচ গুণ বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন, চার গুণ বেশি বায়ুচালিত শক্তির উৎপাদন এবং তিন গুণ বেশি পরিমাণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। তবে কাজে গতি না এলে যে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মূল রোগ হল, সমস্যার কথা অস্বীকার করা। যা এক্ষেত্রেও করেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার বাকিরা। প্রধানমন্ত্রীর মতে, দেশে কোনওভাবেই কয়লার কোনও সংকট নেই। তবে পর্যাপ্ত রেলের রেক না থাকায় সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে কয়লা পাঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। দ্রুত পরিস্থিতি ঠিক হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তাঁর ক্যাবিনেটের মন্ত্রীরা। কিন্তু আর কতদিন? এখন সেটাই দেখার।

 

More Articles

error: Content is protected !!