শুক্রবার সকালেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তিনি এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে ভারতীয় জনতা পার্টি কৃষকদের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। মোদী এদিন বলেন, 'এটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ যে এই আইনের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা কৃষকদের বোঝাতে অসফল হয়েছি।’ তিনি এও জানান যে আর তাই কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনগুলিকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও কিছু সময়ের আগের কথা যদি মনে করা হয় তবে মোদীর কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে এই তিন কৃষি আইন নিয়ে যখন কৃষকরা সুর চড়িয়েছিলেন এবং দিল্লি সীমান্ত সহ অন্যান্য রাজ্যে প্রতিবাদে বসেছিলেন, সেই সময় বিজেপি নেতারা এই কৃষকদের বিরুদ্ধে একাধিক আপত্তিজনক, উস্কানিমূলক ও হুমকি সহ মন্তব্য করেছিলেন। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিছু ১২ জন বিজেপি নেতার মন্তব্য যা মোদী সরকারের দাবীকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
১) 'মাত্র ২ মিনিট লাগবে আপনাদের শাসন করতে’: অজয় কুমার মিশ্র
প্রতিবাদরত কৃষকদের নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে তার মধ্যে যিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি শিরোনামে ছিলেন তিনি হলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় কুমার মিশ্র। এক ভিডিওতে মিশ্র বলেন, 'আমার মুখোমুখি হন, আপনাদের শাসন করতে আমার ২ মিনিট সময় লাগবে।’ তিনি এও বলেন, 'আমি শুধু মন্ত্রী বা বিধায়ক ও সাংসদ নই, আমি সংসদ সদস্য হওয়ার আগে থেকেই যারা আমাকে চেনেন তারা জানেন যে আমি চ্যালেঞ্জ নিতে কখনোই পিছু পা হই না। যেদিন আমি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করব, আপনাদের সবাইকে শুধু পালিয়া (জেলার একটি স্থানীয় জায়গা) নয়, লখিমপুর (তার নির্বাচনী এলাকা) ছেড়ে যেতে হবে।’ প্রসঙ্গত এই অজয় কুমার মিশ্রের ছেলে আশিষ মিশ্র লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গ্রেফতার হয়। সেই সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই মন্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
২) খালিস্তানী পতাকা নিয়ে প্রতিবাদীরা জঙ্গি: জসকউর মীনা
বিজেপি নেতাদের মধ্যে সাধারণ প্রবৃত্তি ছিল কৃষকদের প্রতিবাদকে ভেঙে দেওয়া। যে কারণে তাঁদের 'খলিস্তানী’ বলে অ্যাখা দেওয়া হয় এবং তাঁরা নাকি ভারতের বাইরে থেকে সমর্খন পাচ্ছেন। প্রমাণ ছাড়া এরকমই এক দাবী করেন রাজস্থানের দৌসার বিজেপি সাংসদ জসকউর মীনা, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সত্ত্বেও মীনার এও দাবি ছিল যে কৃষকদের কাছে একে–৪৭ রয়েছে। রাজস্থানের বিজেপির অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে মীনা বলেন, 'এবার এই কৃষি আইনটাই দেখে নিন, আতঙ্কবাদীরা বসে আছে ও আতঙ্কবাদীরা নিজেদের কাছে একে–৪৭ নিয়ে রেখেছে, খালিস্তানী পতাকা লাগানো।’
৩) 'খালিস্তানী ও মাওবাদী’: অমিত মালব্য
বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য কৃষকদের প্রতি একই শব্দ ব্যবহার করেন জসকউর মীনার মতোই। কোনও প্রমাণ ছাড়াই তিনিও প্রতিবাদী কৃষকদের খালিস্তানী ও মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ রয়েছে বলে দাবী করেন। শুধু তাই নয়, তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও দিল্লি জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করার জন্য দায়ী করেন। তবে কেজরিওয়াল এখনও পর্যন্ত কৃষকদেরই সমর্থন করে এসেছেন।
৪) 'গুন্ডারা তথাকথিত কৃষক হিসেবে জাহির করছে’: ওয়াই. সত্য কুমার
অন্য একটি মন্তব্য দেখলে বোঝা যায় যে বিজেপি তিনটি কৃষি আইন সম্পর্কে কৃষকদের উদ্বেগকে সত্যিই গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। পার্টির জাতীয় সম্পাদক ওয়াই. সত্য কুমার দাবি করেছেন যে বিক্ষোভকারীরা মোটেই কৃষক নয় কিন্তু তারা 'গুন্ডা’। তিনি তাদের ভিন্নমত প্রকাশকারীদের 'খালিস্তানি’ এবং 'জিহাদি’ বলেও অভিহিত করেছেন। তিনি টুইটে বলেন, 'উত্তরপ্রদেশে তথাকথিত কৃষকের পরিচয় দিয়ে গুন্ডারা যেভাবে হিংসাত্মক আন্দোলন চালাচ্ছে, তা কাকতালীয় নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন যে 'জিহাদি এবং খালিস্তানি উপাদান’ রাজ্যে অশান্তি ছড়াতে চায়।
৫) 'চরমপন্থীরা হাইজ্যাক করেছে প্রতিবাদকে’: দুষ্যন্ত কুমার গৌতম
বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক ও উত্তরাখণ্ডের রাজ্য ইউনিটের ইন–চার্জ দুষ্যন্ত কুমার গৌতম দাবি করেন যে কৃষকদের প্রতিবাদস্থান থেকে 'খালিস্তানপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী’ স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। যদিও এ ধরনের কোনও স্লোগান প্রতিবাদ স্থান থেকে দেওয়ার কোনও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, 'কৃষি আইন সারা দেশের জন্য, কিন্তু প্রতিবাদ কেন শুধু পাঞ্জাবে? প্রতিবাদকারী মানুষদের মুখে খালিস্তান জিন্দাবাদ ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান শোনা যাচ্ছে। তাহলে এটাকে প্রতিবাদ বলা যায় কী করে?’ তিনি এও বলেন, 'চরমপন্থী উপাদান প্রতিবাদকে হাইজ্যাক করেছে ও যারা দেশবিরোধী শক্তি তাদের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে।’
৬) 'অপ্রত্যাশিত উপাদান’: মনোহর লাল খট্টর
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর দাবি করেছেন যে বিক্ষোভে 'অবাঞ্ছিত উপাদান’ ছিল যারা প্রকাশ্যে খালিস্তানকে সমর্থন করছে। তিনি আরও বলেন, 'আমরা যদি ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করতে পারি, তাহলে নরেন্দ্র মোদীকে কেন নয়-এর মতো স্লোগান দেওয়া হচ্ছে। যদিও তিনি বলেছিলেন যে তাঁর সরকার এই "উপাদানগুলি" খতিয়ে দেখছে।
৭) 'টুকরে টুকরে গ্যাং প্রতিবাদকে হাইজ্যাক করেছে’: সুশীল কুমার মোদী
বিহারের প্রাক্তন উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীল কুমার মোদী বিক্ষোভে আক্রমণ করার জন্য বিজেপির অন্যতম প্রিয় মন্তব্যকে ব্যবহার করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে কৃষক আন্দোলনটি 'টুকরে-টুকরে গ্যাং’ দ্বারা হাইজ্যাক করা হয়েছিল। বিজেপির মতে, এই একই দল দেশের প্রায় সমস্ত ভিন্নমতের জন্য দায়ী–ছাত্র আন্দোলন থেকে সিএএ বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত।
৮) 'নৈরাজ্যবাদী নকশার জন্য গিনিপিগ’: বি.এল. সন্তোষ
বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক বি.এল. সন্তোষ মনে করতেন যে কৃষকরা তাদের নিজেদের উদ্বেগের ভিত্তিতে কাজ করছে না, বরং সমাজকর্মী মেধা পাটকর এবং এএপি নেতারা সহ অন্যদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তিনি টুইটে বলেন 'নৈরাজ্যবাদী নকশার জন্য কৃষকদের গিনিপিগ হতে দেবেন না।’
৯) 'বামপন্থী, মাওবাদীদের অনুপ্রবেশ’: পীযূষ গোয়েল
প্রতিবাদের খুব কম দিনেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল দাবি করেছিলেন যে প্রতিবাদকারীরা আসলে কৃষক ছিলেন না, কারণ প্রতিবাদের মধ্যে 'বামপন্থী’ এবং 'মাওবাদী উপাদান’ দ্বারা অনুপ্রবেশ করেছিল। তারা কৃষকদের ইস্যুতে প্রতিবাদ করছিল না, বরং তারা দেশবিরোধী কার্যকলাপের জন্য গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ করছিল।
১০) 'অশুভ নকশা’: রবি শঙ্কর প্রসাদ
কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও কৃষকদের প্রতিবাদকে অসম্মান করার চেষ্টা করে বিজেপি নেতাদের সঙ্গেই গলা মেলান। তিনি বলেছিলেন যে টুকরে-টুকরে গ্যাং বিক্ষোভের দায়িত্ব নিয়েছে এবং একটি 'অশুভ কিছু এর সঙ্গে জড়িত। এই কারণেই কৃষক ও কেন্দ্রের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছিলেন।
১১) 'চিন এবং পাকিস্তান এই প্রতিবাদের পেছনে’: রাওসাহেব দানভে
আর একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যিনি জনসাধারণকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন যে এঁরা সত্যিই রাস্তার কৃষক নয়, তিনি হলেন রাওসাহেব দানভে। তিনি বলেন, 'যে আন্দোলন চলছে তা কৃষকদের নয়। এর পেছনে চিন ও পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এ দেশের মুসলমানদের প্রথমে উস্কানি দেওয়া হয়। (তাদেরকে) কি বলা হয়েছিল? যে এনআরসি আসছে, সিএএ আসছে এবং ছয় মাসের মধ্যে মুসলমানদের এই দেশ ছাড়তে হবে। একজন মুসলিমও দেশছাড়া হয়েছে? সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি এবং এখন কৃষকদের বলা হচ্ছে যে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এটা অন্য দেশের ষড়যন্ত্র।’
১২) 'দারুণ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’: মনোজ তিওয়ারি
দিল্লির বিজেপি সাংসদ মনোজ তিওয়ারিও 'টুকরে টুকরে গ্যাং’কেই দায়ী করেছেন এই কৃষক প্রতিবাদের পেছনে। তিনি এই প্রতিবাদকে 'দারুণ–পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেন।