বাবর সতীর্থদের কাছে চান টি ২০ বিশ্বকাপ! ভারতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়ে পাকিস্তানের প্রাপ্তি কম নয়
ভারত অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথমবার বিশ্বকাপে পরাজয়ের সাক্ষী হয়ে বলেছেন, একটা জয় বা পরাজয়ে সব শেষ হয় না। টি ২০ বিশ্বকাপ সবে তো শুরু হয়েছে, এখনও অনেক ম্যাচ বাকি! কথাটা ঠিক। তবে ভারতের বিরুদ্ধে এই জয় পাকিস্তান নামক দেশটির কাছে অনেক বড় ব্যাপার। এই জয়ে তাই অনেক খারাপ ভুলে আপাতত উৎসবের মেজাজে কাটাবেন পাক ক্রিকেটপ্রেমীরা। গতকাল ম্যাচ শেষে পাকিস্তানের রাস্তায় দেখা গিয়েছে সেলিব্রেশনের সেই ছবি।
|
মোক্ষম জবাব
এবারের টি ২০ বিশ্বকাপের আগেই পাকিস্তানে গিয়েই সিরিজ না খেলে ফিরে আসে নিউজিল্যান্ড। সফর বাতিল করে দেয় ইংল্যান্ডও। সে সময় পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান রামিজ রাজা ক্রিকেটারদের উদ্দেশে বলেছিলেন, এমনভাবে নিজেদের খেলাকে শীর্ষে নিয়ে যাও যাতে সব দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে খেলার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টি ২০ বিশ্বকাপের আসরেই সেটা সুনিশ্চিত হোক, চেয়েছিলেন রামিজ। পাকিস্তানের অনেকেরই ধারণা ছিল, বিভিন্ন দেশের পাক সফর বাতিলের পিছনে নাকি রয়েছে প্রবল অর্থশালী বিসিসিআইয়ের হাত। যদিও সেই ভুল ভেঙেছে সম্প্রতি। রামিজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-জয় শাহদের সঙ্গে বৈঠক সেরেছেন দুবাইয়ে। ২০২৩ সালের এশিয়া কাপ পাকিস্তানে আয়োজনের আশ্বাস নিয়ে দেশে ফিরে রামিজ বলেছেন, পিসিবি বিসিসিআইয়ের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও উন্নত জায়গায় নিতে যেতে চায়। দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রভাবে সেটা কতদূর সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় থাকছেই।

সফর বাতিল আশীর্বাদ
তবে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড পাকিস্তান সফর বাতিল করায় সেটা পাক দলের কাছে আশীর্বাদও হয়েছে। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি তাই ন্যাশনাল টি ২০ কাপেই নিয়ে ফেলেন পাক ক্রিকেটাররা। হায়দার আলি যেমন ৮ ম্যাটে ৩১৭ রান করেন, তেমনই একটি ঝোড়ো শতরান-সহ ৬ ম্যাচে ২৮৬ রান করেন বাবর আজম। শাহিন শাহ আফ্রিদি ৬ ম্যাচে ১২ উইকেট পান, হাসান আলি আট ম্যাচে নেন ১১ উইকেট। সবমিলিয়ে পাকিস্তানের টি ২০ বিশ্বকাপের দলের ক্রিকেটাররা সেরা প্রস্তুতির সুযোগই পেয়েছিলেন এই টুর্নামেন্টে। শোয়েব মালিক, মহম্মদ হাফিজ, ইমাদ ওয়াসিমরা আবার খেলেছিলেন কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগে। যাকে বৈধতা না দিয়ে আইসিসির কাছে আর্জি জানিয়েছিল বিসিসিআই। মন্টি পানেসররা সরে দাঁড়ালেও মুজাফ্ফরাবাদে সেই লিগে খেলেছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন ও বর্তমান ক্রিকেটাররা। রশিদ লতিফ, হারশেল গিবসরা অভিযোগ করেছিলেন, বিসিসিআই বিভিন্ন বোর্ডকে চাপ দিচ্ছে কাশ্মীর প্রিমিয়ার লিগে কোনও ক্রিকেটার যাতে খেলতে না পারেন তা সুনিশ্চিত করার জন্য। সর্বোপরি, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে পাকিস্তান সুপার লিগের খেলাও টি ২০ বিশ্বকাপের আগে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে পাকিস্তানের তৈরি হওয়ার জন্য।
|
দাপুটে ঐতিহাসিক জয়
ভারত কখনও পাকিস্তানকে বিশ্বকাপে ১০ উইকেটে হারাতে পারেনি। টি ২০ বিশ্বকাপেও ভারত এই ব্যবধানে পাকিস্তানের কাছে হারেনি, পাকিস্তানও এই প্রথম টি ২০ আন্তর্জাতিকে ১০ উইকেটে জয় পেল। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে গতকালের এই পরাজয় বিশ্বকাপে আগের ১২টি সাক্ষাতে জয়ের গৌরবকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ১০ উইকেটে পরাজয়ের লজ্জা সহজে মেটার নয়। তাও এমন একটা সময়ে যখন জম্মু ও কাশ্মীরে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় নিরীহ নাগরিকদের হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে এই ম্যাচ থেকে ভারতের সরে আসা উচিত বলে রাজনীতি-সহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছিল। বিসিসিআই অনড় অবস্থান নেয়। কিন্তু শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যও তো বিরাটরা দিতে পারতেন পাকিস্তানকে হারিয়ে। না, সেটাও পারেনি তথাকথিত হেভিওয়েট ভারত। সুনীল গাভাসকরের কথায়, ভারতকে পাকিস্তান শুধু হারায়নি, এটাকে হ্যামারিং বলা উচিত। সব বিভাগে পর্যুদস্ত হয়ে ভারত পাকিস্তানের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। আর যা সপার্ষদ বসে উপভোগ করেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
|
মনে রাখার মতো
এই জয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান দেখিয়ে দিল খেলা বা সব কিছুতেই চিরস্থায়ী বলে কিছু হয় না। দাপুটে দল, ধারাবাহিকভাবে জয়ী দল, অপরাজেয় খেলোয়াড় সবই অর্থহীন। ভারতের কাছে হারলে পাকিস্তানে যে টিভি ভাঙার প্রতিযোগিতা চলে সেই পাকিস্তানই গতকাল মেতেছে উল্লাসে-উৎসবে। আর সেই জয়টাও কেউ উপহার দেয়নি, ভালো খেলে ছিনিয়ে নিয়েছে বাবরের পাকিস্তান। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে ভারত যে আর অপরাজেয় নয়, বিরাট কোহলিও যে টি ২০ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আউট হন, এ সবই এখন সত্য। এরপর থেকে মানসিকভাবে অনেক চাপমুক্ত থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে পারবে পাকিস্তান। বাবর আজম, মহম্মদ রিজওয়ান আর শাহিন শাহ আফ্রিদি পাকিস্তানে বন্দিত হচ্ছেন ফ্যাব থ্রি হিসেবে। বিশ্বের সেরাদের তালিকায় থাকা এই তিনজনই নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন ভারতের বিরুদ্ধে মহা-ম্যাচে। যেটা গতকাল পারেনি ভারত।
|
নতুন দিশা
বাবর আজম ও মহম্মদ রিজওয়ানের ম্যাচ জেতানো অবিচ্ছেদ্য ওপেনিং জুটির বিশেষত্বও রয়েছে। ১৫২ রানের মধ্যে ৭৮ রান এসেছে বাউন্ডারি থেকে। ৭১ রান বাবরা দৌড়ে নিয়েছেন। দুবাইয়ের প্রচণ্ড গরমেও তাঁদের রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেটস, ফিটনেসের প্রশংসা করতেই হয়। পাকিস্তান এই ইনিংসের মধ্যে দিয়েও দেখিয়েছে টি ২০ মানেই শুধু চার-ছক্কার খেলা নয়। দৌড়ে রান নিয়েও ম্যাচ জেতা যায়। বাবর-রিজওয়ানকে সুপার ফিট বলা হচ্ছে। আর রিজওয়ান টি ২০-তে তাঁর শততম ক্যাচটি ধরে যেভাবে সূর্যকুমার যাদবকে ফিরিয়েছেন তাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে সুপারম্যানও বলা হচ্ছে। পুরো ফিট নন হার্দিক পাণ্ডিয়া, অলরাউন্ডার হয়েও বল করতে পারছেন না। এমন ক্রিকেটারের ভারতীয় দলে থাকা যে দলের ভারসাম্যকেই নষ্ট করে দিচ্ছে সেই খোঁচা দিতেও ছাড়েননি পাক ক্রিকেট লিখিয়েরা।
|
আনন্দের রসদ
পাকিস্তানের ক্রিকেট মহল মনে করছে, এই জয় অবশ্যই দরকার ছিল পাকিস্তানের জন্য। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ অশান্তির পরিবেশ, সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সেনাদের সংঘাত, একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা, বিদ্যুতের অস্বাভাবিক দর, গ্যাসের সঙ্কট, বেহাল অর্থনীতি, পাশের আফগানিস্তানে ডামাডোলের জের-সহ নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে যে দেশ যুঝছে, সেই দেশের মানুষ অন্তত কিছুদিনের জন্য আনন্দের রসদ পেলেন। তাঁরাই মনে করছেন, আসল ম্যাত জেতা হয়ে গিয়েছে। বিশ্বকাপ জিতলে সেটা হবে বোনাস।
|
কাপ জয়ের প্রত্যয়
পাকিস্তান দল টি ২০ বিশ্বকাপ অভিযানে যাওয়ার আগে গোটা দলকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জয়ের সময় পাকিস্তান দলের মানসিকতা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের উদাহরণ টেনে। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতকে হারানোর ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েও গোটা দলকে চাঙ্গা করা হয়েছে। পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম গতকালের ম্যাচের পর সতীর্থদের ফোকাস একইরকম রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা এই জয়ের সেলিব্রেশন করব। তবে অতিরিক্ত উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই। আমাদের কাপ জিততে হবে। ভারতের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে নেওয়ার পর পাকিস্তান যে টি ২০ বিশ্বকাপ জেতার ক্ষমতা রাখে এই বিশ্বাসটাই পেয়ে গেল গোটা দল। বিশেষ করে পাকিস্তানের ব্যাটিং আর বোলিং শক্তি বিপক্ষকে চিন্তায় রাখতে বাধ্য করবে।