৭০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনসংঘ, কেমন ছিল সেখান থেকে আজকের BJP-র যাত্রপথ
২১ অক্টোবর ২০২১ ভারতীয় জনসংঘের ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেএসকে ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরী বা অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো, সরকার এবং দল পরিচালনার আদর্শগত কাঠামোর অতীত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বিজেএসে-ই। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেএস-এর প্রতিষ্ঠা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কারণ ভারতীয় রাজনীততে নেহেরুভিয়ান কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আর কোনও বিকল্প ছিল না। মূলত অক্টোভিয়ান ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ কংগ্রেসের বিকল্প ভারতীয়ত্ব জাতীয়তাবাদ হিসেবেই জন্ম হয়েছিল জনসংঘের।

নেহরুভিয়ান কংগ্রেস ও জনসংঘ
৭০ বছর আগে সে সময় পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং নেহেরুভিয়ান মতাদর্শিক কাঠামো ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী চালিকাশক্তি ছিল। সেই সময়ে এটা ভাবা প্রায় অসম্ভব ছিল যে কেউ সফলভাবে নেহেরু এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করতে পারে! তবে বিজেএস থেকে ৩০০-র বেশি আসনের বিজেপির যাত্রাপথ যথেষ্ট লম্বা ও সংঘর্ষপূর্ণ। কিন্তু ৭০ বছর পরে, যখন ভারতীয় রাজনীতি এবং জনসাধারণের রাজনৈতিক মত বিশ্লেষণ করতে বসা হয় তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে নেহরুভিয়ান কংগ্রেস এবং বিজেএসের মতাদর্শই মূল দুটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে চলেছে৷
এবং এজন্যই বিজেএসের বিবর্তনের দিকে ফিরে তাকানো গুরুত্বপূর্ণ।

জনসংঘেই নিহিত বিজেপির ভিত!
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিজেপি পরে বিকশিত হয়েছিল এবং অবশেষে ২০১৪ থেকে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠে এসেছে। তার আগে অল্প সময়ের জন্য ১৯৭৭-৮০ সালে বিজেএস জনতা পার্টিতে মিলিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালে বিজেএস নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং বিজেপি নামে বিকল্প রাজনৈতিক দল স্থাপনের জন্য তাদের লড়াই চালিয়ে যান। যদিও ১৯৮০তে জনসংঘ একটি নতুন নাম (বিজেপি) পেয়েছিল, কিন্তু এর আদর্শ এবং কাঠামোটি বিজেএসের সাংগঠনিক এবং আদর্শগত কাঠামোর মধ্যে নিহিত রয়েছে বরাবর।

কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জনসংঘ?
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিজেএস-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিজেএস গঠনের মূল কারণগুলির মধ্যে একটি হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ভূমিকা যা নেহরুভিয়ান দৃষ্টান্তের সাথে কখনও সহমত হতে পারেনি।
১৯৪৮ এ মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর ভুলভাবে আরএসএস-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। সংগঠনটির প্রচুর কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেই সময় RSS কে সমর্থন করার জন্য খুব কমই কোন রাজনৈতিক আওয়াজ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বুঝতে পেরেছিল একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন রয়েছে যারা আরএসএস-এর মতাদর্শকে ভারতীয় শাসনব্যবস্থার সুরক্ষা দিতে সক্ষম হবে৷ ঠিক এই ভাবনা থেকেই জনসংঘের জন্ম হয়৷

কংগ্রেসকে RSS-এর চ্যালেঞ্জের নাম ছিল জনসংঘ!
১৯৪৯ সালে যখন আরএসএস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তখন সংগঠনের মধ্যে আরএসএস-এর ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈর হয়। সংঘের একটি অংশ চেয়েছিল যে এটি সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করুক। বিভিন্ন স্তরে এই তীব্র বিতর্ক এবং আলোচনার পর দ্বিতীয় সারসংঘচালক এম.এস. গোলওয়ালকর ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা নেহেরু এবং কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারার সম্ভবনা ছিল।

ভারতে আর একটা বিজেপি তৈরি করতে পারেনি অন্যরা!
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির প্রেক্ষিতে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নেহরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। মজার বিষয় হল, বিজেএসের প্রতিষ্ঠা ছিল সাংগঠনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি অন্য রকমের চ্যালেঞ্জ। বহু চেষ্টার পরও অন্য কোন ভারতীয় রাজনৈতিক দল আজও এর অনুকরণে আরএকটা বিজেপি তৈরি করতে পারেনি। সাধারণত, রাজনৈতিক দলগুলি প্রথমে তাদের জাতীয় সংগঠন স্থাপন করে এবং তারপর তাদের রাজ্য ও জেলা স্তরে ইউনিট স্থাপন শুরু করে। কিন্তু জনসংঘের ক্ষেত্রে, রাজ্য-স্তরের ইউনিটগুলি আগেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিজেএস আনুষ্ঠানিকভাবে, একটি জাতীয় ১৯৫১ সালের ২১ অক্টোবর দিল্লিতে একটি সম্মেলনে সর্বভারতীয় দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতীয় জনসংঘ।

ঐতিহ্য মেনেই এখনও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ থেকে বিজেপিতে আসেন মোদী-রা!
সংগঠনের শুরুর দিকে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গোলওয়ালকর, বালাসাহেবের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে কাজ করতেন৷ সে সময় নাগপুর সংঘচালক বাবসাহেব ঘাটতে বাড়িতেও গিয়ে দেখা করেছিলেন ডঃ মুখোপাধ্যায়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ শুধুমাত্র বিজেএস-কে পুরোপুরি সমর্থনই করেনি বরং নতুন প্রতিষ্ঠিত এই রাজনৈতিক দলকে সাহায্য করার জন্য সাংগঠনিক কাজে সংঘের কিছু প্রচারকেও (পূর্ণ-সময়ের কর্মী) বিজেএসে পাঠানো শুরু করে এই বৈঠক থেকেই। এই ঐতিহ্য মেনেই দিলীপ ঘোষ থেকে নরেন্দ্র মোদীরা এখনও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ থেকে বিজেপিতে আসেন।