জয়পালের টিনের চালার, দুই কামরার ইটের বাড়িতে আরও অজস্র বড়ো বড়ো বাড়ি আছে। বহুতল এই বাড়িগুলিতে আছে দীর্ঘকায় থাম, বারান্দা আর ছোটো ছোটো গম্বুজ।

সেসবই অবশ্য কাগজ আর আঠা দিয়ে তৈরি।

মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়া জেলার করোলি গ্রামে নিজের বাড়িতে বসে ১৯ বছর বয়সী জয়পাল চৌহান বিগত ৪-৫ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে আর দুপুরে খানিক সময় ব্যয় করে সযত্নে নলাকারে পাকানো কাগজ থাক থাক করে ইটের মতো সাজিয়ে প্রাসাদ নির্মাণে।

“বাড়ি তৈরির ব্যাপারে আমার আগ্রহ চিরদিন,” সে জানায়।

১৩ বছর বয়স থেকেই কার্ডবোর্ড দিয়ে বিভিন্ন মন্দিরের অনুকৃতি তৈরি করা দিয়ে পথ চলা শুরু। একবার একটা বিয়েবাড়ি গিয়ে সে একটি মন্দিরের কাচের মডেল দেখে — এতোটাই আগ্রহ জন্মায় যে নিজেই কার্ডবোর্ড দিয়ে তেমন একটি বানাবার চেষ্টা করবে বলে স্থির করে। সেই মতো বানিয়ে, কয়েকটি অত্মীয়স্বজনকে উপহারও দেয়, এমনকি ২০১৭ সালে সে স্কুলের মডেল তৈরির পড়ুয়াদের একটি প্রদর্শনীতে পুরস্কারও লাভ করে।

এরপর আবার কার্ডবোর্ড দিয়ে একটি মোটরবাইক বানিয়েও নিজের বিদ্যালয়ে পুরস্কৃত হয়েছে জয়পাল। এছাড়াও তার সংগ্রহে নিজের বানানো একটা টেবিল-পাখা, রেসের গাড়ি, আর একটা খেলনা থেকে চাকা খুলে নিয়ে বানানো চাকা লাগানো ক্রেনও আছে।

PHOTO • Nipun Prabhakar

কাগজের তৈরি একটি মডেল-সহ জয়পাল; তা র বাবা, দি লা ওর চৌহান ( পেশায় কাঠমিস্ত্রি) যে দরজাগুলি বানান তার নক্সাও জয়পালের রা

জয়পাল জানালো, “ক্রমে, আবহাওয়ার আর্দ্রতার জন্য কার্ডবোর্ড বেঁকে যেতে শুরু করল। তারপর আমি একদিন ভাবলাম যে বরং বিক্রি করে দেওয়ার জন্য রাখা আছে (ইস্কুলের) পুরোনো যেসব বই সেগুলোই ব্যবহার করব। হঠাৎই আমার এই চিন্তাটা মাথায় এসেছিল। সেগুলির পাতা গুটিয়ে নল বানিয়ে এই বাড়ির (বড়ো) মডেলগুলি বানাতে শুরু করলাম।”

পুনাসা তেহসিলে নিজেদের গ্রাম করোলিতে যে সিমেন্টের বাড়িগুলি তৈরি হচ্ছে সেগুলি দেখেই তার কল্পনার দরজা খুলে যায়। “যারা নিজেদের জন্য এই পাকা বাড়িগুলি বানাচ্ছে তারা গ্রামের মধ্যে থাকে আর আমরা (তার পরিবার) কিংবা যারা অপরের জমিতে কাজ করি তারা গ্রামের বাইরে কাঁচা বাড়িতে থাকি,” বলল জয়পাল। “সিমেন্টের বাড়িগুলির কোনোটারই নক্সা আমার পুরোপুরি পছন্দ হয় না। ফলে আমি এটার সঙ্গে ওটার নক্সা মিলিয়ে নিজের মতো করে বানাই। নক্সা খুব সাধারণ হলে দেখতে বড়ো সাদাসিধে লাগে, কিন্তু যদি একটু অন্যরকম হয় তাহলেই আমি তার পেপার-মডেল বানাই।”

যে সব বাড়ির দরজা জানালা সাদাসিধে না হয়ে বেশ কারুকাজ করা, সেইসব বাড়ি জয়পাল খুঁজে বেড়ায়। সে জানায়, একটি মডেলে, “আমি উপর তলাটা গ্রামের সব বাড়ির মতো করে, নিচের তলাটা করেছি ভিন্ন কায়দায়।” স্থানীয় এক শিক্ষক, যিনি জয়পালকে নিজের স্কুল থেকে পুরোনো খাতা এনে দিতেন, তাঁর বাড়িটি দেখে জয়পাল অনুপ্রেরণা পায়। কিন্তু মাস্টারমশাই যে খাতাগুলি দিতেন তাতে রকমারি ছবি থাকত, যা কাগজের মডেলে অদ্ভুত দেখাত। কাজেই সে কাছাকাছি একটি সরকারি বিদ্যালয় থেকে পুরোনো খাতা বই জোগার করে আনে।

জয়পালের কথায়, “আমি কোনও (স্থাপত্য) নক্সা আগে থেকে এঁকে নিই না, সরাসরি এগুলি তৈরি করতে শুরু করি।” প্রথম কয়েকটি আত্মীয়স্বজনকে উপহার হিসাবে দেওয়ার পর যখন দেখল যে সবাই তার বাড়িতে সেগুলি দেখতে আসছে তখন সে মডেলগুলি উপহার দেওয়া বন্ধ করে দিল। এখনও অবধি সে কোনও মডেল বিক্রি করেনি, কয়েকটি তার বাড়িতে সাজানো আছে যাতে সবাই দেখতে পায়।

PHOTO • Jaypal Chouhan
PHOTO • Jaypal Chouhan

নক্সাদার বাড়ির খোঁজে থাকে জয়পাল । তার ভাবনায় এই নক্সাটি (ডান দিকে ) আসে স্থানীয় এক শিক্ষক, যিনি তা কে পুরোনো খাতা এনে দিতেন, তাঁর বাড়িটি (বাঁ দিকে ) দেখে

বাড়ির নক্সার জটিলতা আর কতটা সময় সেগুলি তৈরিতে ব্যয় হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে জয়পালের ২X২ ফিট উচ্চতা ও গভীরতা এবং ২.৫ ফিট প্রস্থের এক একটি কাগজ নির্মিত বাড়ি তৈরি করতে ৪ থেকে ২০ দিন অবধি লাগে।

যখন জয়পাল প্রাসাদ নির্মাণের কাজ থেকে দূরে আছে মানে বুঝতে হবে সে তার পড়াশুনায় মন দিয়েছে — কাছাকাছি অন্য একটি গ্রামের স্কুল থেকে সে সম্প্রতি দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ (অতিমারির কারণে) অনলাইনে সম্পূর্ণ করেছে। ওর বাবা, ৪৫ বছর বয়সী দিলাওর সিং চৌহান পেশায় ছুতোর। তিনি করোলি ও কাছাকাছি অন্যান্য গ্রাম শহরে, চেয়ার টেবিল, বাচ্চাদের দোলনা, অন্যান্য আসবাবপত্র, দরজা জানালার ফ্রেম, চৌকাঠ ইত্যাদি তৈরি করেন। জয়পালও বাবার কাজে সাহায্য করে।

জয়পাল জানায় যে কাঠের কাজে তার আদতে কোনও আগ্রহ নেই, কিন্তু দরজা জানালার নক্সা তৈরির কাজে সে উৎসাহী আর সাহায্য করে যন্ত্রপাতি দিয়ে টিনের চালা লাগাতে। তার নিজের কথায়, “আমি কাছের গ্রামে দুটি দরজার নক্সা করেছি আর একটি করেছি করোলি গ্রামে। ইন্টারনেট থেকে অথবা অনলাইন পত্রিকা থেকে নক্সা দেখে নতুন কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করি। কখনো কখনো কাগজে করি কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই সরাসরি কাঠের উপরেই করি — তারপর বাবা সেগুলিকে আকার দেন।”

এক এক সময়ে জয়পাল নিজের জামাইবাবুর সঙ্গেও কাজ করে — তিনি ৬০ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে দর্জির কাজ করেন। মাঝে মাঝে জয়পাল সেখানে গিয়ে কাপড় কাটা বা প্যান্ট সেলাই করার কাজে হাত লাগায়।

জয়পালের মা, রাজু চৌহানের বয়স ৪১। তিনি ঘর-গেরস্থালির দেখাশুনা করেন। আগে তিনিও পারিবারিক কাঠের কাজে যোগ দিতেন। “খাটিয়া বানানো হলে মা খাটিয়ার পায়াগুলি তৈরি করতেন আর বাবা করতেন বাকি আর সব অংশ,” জয়পাল জানায়। এখন এই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খানিক ভদ্রস্থ হওয়ায় তিনি এই কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

PHOTO • Jaypal Chouhan
PHOTO • Jaypal Chouhan

জয়পালের নিজের হাতে তৈরি জিনিসের সম্ভারে একটি টেবিল-পাখা আছে; সে কিছু দরজার নক্সাও করেছে, যেগুলি র উপর তার বাবা কাঠ দিয়ে কাজ করেছেন

কাগজের মডেল তৈরি করতে তাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিতেন তার মামা মনোহর সিং তনওয়ার। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন। তিনি পাশের বাড়িতেই থাকতেন আর সব বন্ধুদের নিয়ে আসতেন নিজের ভাগ্নের হাতের কাজ দেখাতে। এই মামা গতবছর মারা যান, খুব সম্ভব তাঁর ডেঙ্গু হয়েছিল।

দিলাওর সিং ও রাজু সিং দুজনেই নিজের ছেলের এই মডেল বানানোর কাজে যথেষ্ট উৎসাহ দেন। দিলাওর বলছিলেন, “আমি লেখাপড়া জানি না বটে কিন্তু এটুকু আমি জানি যে ও ঠিক পথই বেছে নিয়েছে। কতো মানুষ আসে ওর কাজ দেখতে। আমি চাই ও নিজের ইচ্ছামতো যতটা চায় লেখাপড়া করুক। আমি ওকে আমার সাধ্য মতো সাহায্য করব — জমি আবার কেনা যেতে পারে কিন্তু ওর লেখাপড়া শেখার সময়টা আর ফিরে আসবে না।” রাজু আমাকে এটুকুই বললেন যে, “ওকে দেখো। আমাদের খুব বেশি কিছু নেই আর ও-ই আমাদের একমাত্র সন্তান যে এখন আমাদের কাছে আছে, ওর (দুই) দিদির তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

জয়পালের হাতের কাজ দিয়ে ওদের ঘরখানি সাজানো বটে কিন্তু উচ্ছেদ আর বিস্থাপন এই পরিবারের পিছু ছাড়ে না। ২০০৮ সালে করোলি থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে নিজেদের গ্রাম টোকি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল পরিবারটিকে। ওঙ্কারেশ্বর বাঁধ থেকে ছাড়া জলে সেই গ্রামটি জলের তলায় চলে যায়।

পরিবারটিকে ১০ কিলোমিটার দূরে অন্য একটি গ্রামে সরে যেতে বলা হলেও জায়গাটি বহু দূরে বলে বাধ সাধেন দিলাওর। “সেখানে না ছিল কোনও দোকানপাট, আর না ছিল কোনও কাজকর্ম,” বললেন জয়পাল। তারপর ওর বাবা, সরকারি ক্ষতি পূরণের টাকা দিয়ে করোলিতে ছোট্টো একটুকরো জমি কেনেন। সেই জমির উপর তৈরি করা বাড়িটিই এখন পরিবারের ঠিকানা। এছাড়া, করোলি থেকে আন্দাজ ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে, দিলাওর নিজের বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন দুই একর জমি; সেই জমিতে পরিবারটি প্রধানত সোয়াবিন, গম আর পেঁয়াজ চাষ করে।

PHOTO • Jaypal Chouhan
PHOTO • Jaypal Chouhan

“আমি কোন (স্থাপত্য) নক্সা আঁকি না, সরাসরি বাড়ি র মডেল গুলি বানাতে শুরু করে দি ই,’ বলল জয়পাল। প্রথম কয়েকটি বানিয়ে সে আত্মীয়স্বজনদের উপহার দিয়েছিল, কিন্তু যখন সবাই এগুলি দেখতে বাড়িতে আসতে শু রু করল তখন জয়পাল এগুলি কে উপহার হিসেবে দিয়ে দেওয়া বন্ধ করল

টোকি গ্রামের যে সাধারণ টিনের চালার মাটির বাড়িতে জয়পাল জন্মেছিল তা আবছা স্মৃতি হয়ে মনে উজাগর হয়ে আছে জয়পালের। “আমার খুব বেশি মনে নেই সেই বাড়ি। মডেল তৈরি করার সময়ে গিয়ে সেটা দেখে আসতেও পারব না কারণ সেই বাড়ি এখন জলের তলায়। কিন্তু আমার এখনকার ছোট্টো বাড়িটার একটা মডেল আমি তৈরি করব ভাবছি,” বললেন জয়পাল।

পরিবারটি অবশ্য এই বাড়ি থেকেও উৎপাটিত হতে পারে কারণ যে জমির উপর এই বাড়িটা তা এমন একটা রাস্তার ধারে যেটাকে সরকার চওড়া করে ছয়-লেন সড়কে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করছে। “তাহলে আমাদের আবার অন্য কোথাও চলে যেতে হবে,” বলল জয়পাল।

নির্মাণ প্রযুক্তি ঘিরে উৎসাহ থেকেই তার আরও পড়াশুনা করে সিভিল এঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন জন্ম নিয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা সরকারি চাকরি পেতে সহায়ক হবে বলে সে বিশ্বাস করে।

কিছুদিন হল সে তাজমহলের একটি মডেল বানাতে শুরু করেছে। সে জানায়, “আমাদের বাড়িতে মডেলগুলি দেখতে আসে যারাই আসে, সব্বাই জিজ্ঞেস করে যে আমার তাজমহল বানানো শেষ হল কি না।” এটা বানাতে কাগজ অনেকটা লাগবে, সেই আলিশান স্থাপত্যকীর্তিটি ক্রমেই রূপ নিচ্ছে। দক্ষতা, ধৈর্য, আঠা আর বাতিল কাগজের স্তূপ দিয়ে ভবিষ্যতে এমন আরও কতশত মডেল জন্ম নেবে।

অনুবাদ: চিলকা

Nipun Prabhakar

Nipun Prabhakar is a documentary photographer based in Kachchh, Bhopal and Delhi. He is also a trained architect and works extensively with local communities.

Other stories by Nipun Prabhakar
Translator : Chilka

Chilka is an associate professor in History at Basanti Devi College, Kolkata, West Bengal; her area of focus is visual mass media and gender.

Other stories by Chilka