হকিতে আধিপত্য
৪১ বছরের খরা মিটিয়ে টোকিও অলিম্পিকে ভারতীয় হকির পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। পুরুষ হকি দল জিতেছে ব্রোঞ্জ, মহিলা হকি দল সেমিফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়ে। অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ হাতছাড়া হয়। যদিও এই সাফল্য উজ্জীবিত করেছে ভারতীয় হকিকে। ইতিমধ্যেই হকিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণার দাবি ফের জোরালো হয়েছে। হবে না-ই বা কেন? স্বাধীনতার আগে সব কটি অলিম্পিকেই ভারত হকিতে সোনা জিতেছিল। স্বাধীনতার পর পাঁচটি অলিম্পিকে সোনা জেতার পাশাপাশি ৯টি পদক জিতেছে ভারত, যার মধ্যে একটি রুপোও রয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের ১২ অগাস্ট লন্ডনের ওয়েম্বলিতে গ্রেট ব্রিটেনকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে অলিম্পিকে সোনা জিতেছিল ভারত, স্বাধীনতা-লাভের এক বছরের মধ্যে এই সাফল্যও তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
নীরজের ইতিহাস
টোকিও অলিম্পিকেই ইতিহাস গড়েছেন নীরজ চোপড়া। জ্যাভলিনে সোনা জিতে। ১৯০০ সালের অলিম্পিকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভারতকে দুটি পদক এনে দিয়েছিলেন নর্মান প্রিচার্ড। কিন্তু সোনা জেতাতে পারেননি। স্বাধীনতার পরবর্তী অধ্যায়ে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে অলিম্পিকের পদক মাত্র ০.১ সেকেন্ডের জন্য হাতছাড়া হয়েছিল কিংবদন্তি মিলখা সিংয়ের। ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে ৪০০ মিটার রেসে। প্রয়াণের কয়েক মাস আগে মিলখা সিং জানিয়েছিলেন,মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চান কেউ ভারতকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে সোনা এনে দিচ্ছেন। সেই কথাকে স্মরণ রেখে নীরজ চোপড়া জ্যাভলিনে ঐতিহাসিক সোনা জেতার পর তা উৎসর্গ করেন ফ্লাইং শিখ মিলখা সিংকে। তিনি বলেন, যেখানেই থাকুন এই সোনার পদক জিতে তিনি নিশ্চিতভাবেই আজ তৃপ্তি অনুভব করছেন। নীরজের সোনার সুবাদে অলিম্পিকে এই প্রথম স্বাধীনতার পর ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভারত পেল প্রথম পদক, সেটিও সোনা।
ক্রিকেটে বিশ্বকাপ
ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট। আর সেই ক্রিকেটেই মহাশক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে লর্ডসে কপিল দেবের ভারতের বিশ্বকাপ জয়ও আরেক গৌরবময় মুহূর্ত। বিশ্বকাপজয়ী দলের প্রথম একাদশে ছিলেন সুনীল গাভাসকর, কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত, মোহিন্দর অমরনাথ. যশপাল শর্মা, সন্দীপ পাটিল, কপিল দেব, কীর্তি আজাদ, রজার বিনি, মদন লাল, সৈয়দ কিরমানি ও বলবিন্দর সিং সান্ধু। তিরাশির বিশ্বকাপ জয় ভারতীয় ক্রিকেটকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে দেয় তা-ই নয়, ক্রিকেটের প্রতি অনেককেই আকৃষ্ট করেছিল। সেই ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে কপিলের উত্তরসূরীদের হাত ধরে। ২০০৭ সালে প্রথম টি ২০ বিশ্বকাপটিও জেতে ভারত, মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে।
বিন্দ্রার সোনা, চানুর রুপো
অলিম্পিক হকিতে ভারত সোনা জিতলেও ব্যক্তিগত সোনাটি জিতে ইতিহাস গড়েছিলেন শুটার অভিনব বিন্দ্রা। ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিকে। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে। শেষ শটের আগে ফিনল্যান্ডের হেনরি হাক্কিনেনের সঙ্গে যুগ্মশীর্ষে ছিলেন। শেষ শটে বিন্দ্রা ১০.৮ স্কোর করতেই নিশ্চিত হয় সোনা। এর চেয়ে কম হলেই হাতছাড়া হত সোনাটি। বেজিংয়ে নিজের দ্বিতীয় অলিম্পিকেই আসে এই ঐতিহাসিক পদকটি। বিন্দ্রার পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে এবার টোকিওয় ব্যক্তিগত বিভাগে সোনা জিতেছেন নীরজ চোপড়া। বিন্দ্রা নিজে পাঁচটি অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে উত্তেজনাপূর্ণ শুট-অফে তিনি ছিটকে যান। এবারের টোকিও অলিম্পিকে ব্যক্তিগত বিভাগে ভারোত্তোলনে দেশকে প্রথম রুপো এনে দিয়েছেন মীরাবাঈ চানু। কর্ণম মালেশ্বরী দেশের প্রথম ভারোত্তোলক হিসেবে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন সিডনি অলিম্পিকে। ২১ বছর পর সেই পদকের রং বদলে ইতিহাস গড়লেন চানু।
বক্সিংয়ে গর্বের ত্রয়ী
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে দাপট দেখিয়ে আসছেন ভারতীয় বক্সাররা। আর অলিম্পিকের আসর থেকে পদক আনতে পেরেছেন তিন ভারতীয় বক্সার, যাঁদের মধ্যে দুজনই মহিলা। প্রবাদপ্রতিম বক্সারদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম উল্লেখ করতে হবে তিনি ছ-বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এমসি মেরি কম। ৫১ কেজি বিভাগে তিনি লন্ডন অলিম্পিক থেকে ব্রোঞ্জ জিতে ফিরেছিলেন। বক্সিংয়ে ভারতকে প্রথম পদক অবশ্য এনে দিয়েছিলেন বিজেন্দ্র সিং। আর টোকিওয় ভারতীয় বক্সাররা হতাশাজনক পারফরম্যান্স করলেও উজ্জ্বল লাভলিনা বরগোঁহাই। অসমের এই বক্সার এবারই প্রথম অলিম্পিকে অংশ নিয়ে জিতেছেন ব্রোঞ্জ।
কুস্তির সাফল্য
কুস্তিতে ভারতের সফলতম হলেন সুশীল কুমার, যদিও একটি খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি এখন জেলবন্দি। সুশীলই প্রথম ক্রীড়াবিদ যাঁর ঝুলিতে নিশ্চিত হয়েছিল অলিম্পিকের জোড়া পদক। ২০০৮ সালে বেজিংয়ে ব্রোঞ্জ ও ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে তিনি রুপো জেতেন। টোকিওয় কাঙ্ক্ষিত সোনা না এলেও রুপো জিতে ফিরেছেন রবি কুমার দাহিয়া। বজরং পুনিয়া জিতেছেন ব্রোঞ্জ। কুস্তিতে অবশ্য ভারতকে প্রথম অলিম্পিক পদক এনে দিয়েছিলেন কেডি যাদব, ১৯৫২ সালের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে তিনি ব্রোঞ্জ জেতেন। এ ছাড়া ২০১২ সালে যোগেশ্বর দত্ত ও ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে সাক্ষী মালিক ব্রোঞ্জ জয় করেন।
সিন্ধু গর্জন
ব্যাডমিন্টনে ভারতকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছেন সাইনা নেহওয়াল। তাঁর উত্তরাধিকার বহন করে সেই সাফল্যকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন পিভি সিন্ধু। সিন্ধুই একমাত্র মহিলা ক্রীড়াবিদ যাঁর দখলে রয়েছে দুটি অলিম্পিক পদক। ২০১৬ সালের অলিম্পিকে রুপো জেতার পর এবার ব্রোঞ্জ। সাইনা লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন।
অলিম্পিকে লিয়েন্ডার
অলিম্পিকে টেনিসে ভারতের একটিই পদক রয়েছে। ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন লিয়েন্ডার পেজ। কেডি যাদবের পর অলিম্পিকে ৪৪ বছরের খরা মিটিয়ে সেবারই প্রথম পদক জিতেছিলেন লি। তাঁর এই ব্রোঞ্জ জয়ের পর টেনিসে আর অলিম্পিক পদক পায়নি ভারত।
আনন্দের গৌরব
দাবার ক্ষেত্রেও ভারতের গৌরব কোনও অংশে কম নয়। আর ভারতীয় দাবার কথা উঠলে প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসে তিনি হলেন বিশ্বনাথন আনন্দ। ১৯৮৮ সালে তিনি গ্র্যান্ডমাস্টার হন। ১৯৭৫ সালের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে আনন্দই প্রথম যিনি ২০০০ সালে ফিডে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব জেতেন। ২০০২ সাল অবধি এই খেতাব তিনি ধরে রাখেন। ২০০৭ সালে প্রথমবার দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ ভারতীয় দাবার এক পথিকৃৎ।