বলাগড়ের বিধায়কই বিজেপি-র 'মনোরঞ্জন'! মমতার পদক্ষেপের আশায় শয্যাশায়ী তৃণমূল কর্মী

একের পর এক ফেসবুক পোস্ট। আর তাতেই বারবার দলকে বিব্রত করছেন তৃণমূলের দলিত সাহিত্যিক বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। সম্প্রতি খেলা হবে স্লোগান তুলে তিনি ফেসবুকেই বলাগড়ের দলীয় নেতৃত্বকে খুল্লমখুল্লা আক্রমণ করছেন। যা চওড়া করছে বিরোধী বিজেপির হাসি। এমন খেলা সহ্য করতে পারছেন না নির্বাচনের ফল বেরনোর পর বিজেপির হাতে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসায় আক্রান্ত এবং শয্যাশায়ী তৃণমূল কর্মী বাপ্পা ঘোষ।

বিতর্কিত বিধায়ক

বিগত কয়েক দিন ধরেই বলাগড়ের বিধায়কের বিতর্কিত কিছু ফেসবুক পোস্ট তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এনেছে। যাতে তাঁর আক্রমণের মূল নিশানা প্রাক্তন বিধায়ক তথা বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক অসীম মাঝি, হুগলি জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সহ সভাপতি শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ব্লক সভাপতি নবীন গঙ্গোপাধ্যায়। যেখানে কোথাও তিনি প্রাক্তন বিধায়ককে নির্বোধ বলছেন, কোথাও আবার সকলের গায়েই লাগিয়ে দিয়েছেন গদ্দার, বেইমান তকমা! তাঁর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠলেও যা করেছেন ঠিক করেছেন গোছের ভাব নিয়ে এদিনও তিনি বলেছেন, আমার নির্বাচনের প্রচারে যাঁরা কেউ সক্রিয় ছিলেন না, আমার বিরুদ্ধে ভোট দিতে লোকজনকে বলেছিলেন, যাঁরা ভেবেছিলেন লোকসভা ভোটে ৩৬ হাজার ভোটে পিছিয়ে থাকা আসনে আমি হারব, তাঁরা আমি জেতায় সহ্য করতে পারছেন না। আক্রোশ জন্মেছে। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে আমি দলের জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে গোটা বিষয় জানিয়েছি। বিধায়কের ফেসবুক পোস্টে বিতর্ক বাড়লেও পোস্ট হয়েই যাচ্ছে দেখে তৃণমূল কর্মীরাও বিভ্রান্ত।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ইন্ধন

সম্প্রতি জিরাট কলেজের সামনে ফ্লেক্সে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবির নীচে অসীম মাঝি ও শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি থাকায় তা সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন বিধায়ক। সেই ফ্লেক্স সরিয়ে শৌচাগারের কাছে রাখা দেখে দলনেত্রীকে অসম্মানের অভিযোগে অধ্যক্ষের কাছে প্রতিবাদ জানান ছাত্র-ছাত্রীরা। পরে ফের তা লাগানো হলেই তৃণমূল নেতৃত্বই পরে গিয়ে তা খুলে নেয়। সংবাদমাধ্যমের সেই খবর শেয়ার করেছেন বিধায়ক তাঁর ফেসবুক পোস্টে। যদিও তাঁর প্রচারে অংশ না নেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেই সরব হয়েছে দলের একাংশ। সাধারণ কর্মীরাও বিভিন্ন পোস্ট করছেন যাতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সমর্থনে দিন-রাত খেটেছেন অসীম মাঝি, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়রা।

বিধায়কের ফুল টস ডেলিভারি

গতকাল ফেসবুক পোস্টে মনোরঞ্জন ব্যাপারী লিখেছিলেন, "যারা বন্দুক রিভালবার দেখিয়ে ভোটে জেতে তাদের জনগনের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা থাকে না । তাঁরা মনে করে ওইভাবে বার বার জিতে যাবে। আমি তেমন ভাবে জিতি নি , জিততে চাই না। আমি জিতেছি মা মাটি মানুষের নেত্রী দিদি মমতা ব্যানার্জীর আশীর্বাদ আর আপনাদের ভালোবাসায়।" (বিধায়কের লেখা বানান হুবহু তুলে ধরা হয়েছে) তাঁর এই অংশই অক্সিজেন দিয়েছে বিরোধীদের দাবিকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসনে ভয় দেখিয়ে মনোনয়নে বাধাদান, নির্বাচনী হিংসার জেরেই তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এক-তৃতীয়াংশ আসন জিতেছিল বলে অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। এমনকী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গড় ডায়মন্ড হারবার-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেই সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী হিংসার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক আসন বিরোধীশূন্য করে তৃণমূল জেতে বলে অভিযোগ করেছিল বিজেপি। এখন বলাগড়ের বিধায়কের পোস্ট বিরোধীদের সেই দাবিকেই মান্যতা দিচ্ছে বলে অভিমত রাজনৈতিক মহলের। সেই বক্তব্য শেয়ার করতে শুরুও করেছে উল্লসিত বিজেপি। তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা বলছেন, এতে তো আমাদের বিধায়ক বিরোধীদের হাতই শক্ত করছেন!

আসরে নেমেছে বিজেপি

গোটা বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে বলাগড়ের বিধায়কের দলকে অস্বস্তিতে ফেলা বক্তব্য বলাগড়ে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি বেচু নায়েক তাঁর ফেসবুক পেজে শেয়ার করায়। বন্দুক দেখিয়ে বাংলায় ভোট হয়, তৃণমূলের বিধায়কের এমন বক্তব্য বিজেপির কাছে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই। বিধায়কের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বও। প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে জানাচ্ছেন, যেখানে পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা নিয়ে বিরোধীরা হিংসার রাজনীতি নিয়ে সরব হয়েছিল, আমাদের বিধায়ক সেই কথাকেই মান্যতা দিয়ে তো দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেই অস্বস্তিতে ফেললেন। শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও ভোটের সময় বন্দুক দেখিয়ে নমিনেশনে বাধাদানের কথা প্রকাশ্যে ফেসবুকে লিখেছেন বিধায়ক। যদিও বিধায়কের মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি শান্তনু এবং প্রাক্তন বিধায়ক অসীম মাঝি। বিরোধীদের কটাক্ষ, বলাগড়ে বহিরাগত বিধায়ক আনার ফল ভুগছে তৃণমূল। তিনি যে কাজ করতে পারছেন না তা পরিষ্কার। সত্যি কথাই বলে ফেলছেন। কতদিন তিনি এই দলে থাকতে পারেন দেখা যাক।

মমতার ভরসায় আক্রান্ত পরিবার

তবে দলনেত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে সরব হয়েছেন ভোটের ফল প্রকাশের পরদিন আক্রান্ত তৃণমূল কর্মী বাপ্পা ঘোষ। বাপ্পা ঘোষ, তাঁর ভাই বাপন-সহ জনা পঁচিশ তৃণমূল কর্মীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। বাপ্পার পেটে ছুরি চালানো হয়, বাপনের কাঁধে হাঁসুয়া দিয়ে কোপ মারা হয়। থানায় যে এফআইএর দায়ের হয় তাতে সাত নম্বরে নাম রয়েছে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি বেচু নায়েকের। অথচ তিনিই মনোরঞ্জন ব্যাপারীর বক্তব্য ফেসবুকে শেয়ার করছেন! বাপ্পা ঘোষ জানালেন, আমার উপর হামলার পরদিন বিধায়ক আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। ছবি তুলে চলে গিয়েছিলেন, তারপর আর খোঁজ পর্যন্ত নেননি। ঘটনার রাতে বিধায়কের ফোন সুইচ অফ ছিল। তাঁকে ফোনে পাইনি। তাঁর ছায়াসঙ্গী শ্যামাপ্রসাদ রায় বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন ধরে বলেছিলেন, দেখছি। তখন রাত ১১টা। কিন্তু তিনিও আসেননি। অথচ হামলার খবর পেয়েই ছুটে এসেছিলেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। বিপদে কাউকে পাশে পাইনি। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে প্রথমে চুঁচুড়া ও পরে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করান, প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদা মিটিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। নাহলে মরে যেতাম। শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের কয়েকজন আমার পরিবারকে দেখছেন। এখনও আমি শয্যাশায়ী। কয়েকদিন আগে ফের অসুস্থ হওয়ায় এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকরাই ভালো করেছেন। অথচ আক্ষেপ যে মণ্ডল সভাপতি অভিযুক্ত তাঁর বাড়িতে পুলিশ পর্যন্ত যায়নি। কেন যায়নি সেটা আজ তাঁর ফেসবুক পোস্ট দেখে বুঝছি। তবে বুঝছি যাঁর জন্য খাটলাম ভোটে জিতে তিনি আমাদের না দেখে বিজেপির হাত শক্ত করছেন। আক্রান্ত হলাম, তারপরও অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে ঘুরছে। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে। বিশ্বাস, সব কিছু জেনে তিনি সঠিক এবং যথাযথ পদক্ষেপই করবেন।

More MAMATA BANERJEE News  

Read more about:
English summary
TMC MLA Of Balagarh Manoranjan Byapari Slams Party Leaders For Violence During Panchayat Election. BJP Sharing Balagarh MLA's Facebook Posts.