অলোর রোশনাই-আবেগে ভাসল সমাপ্তি
করোনা ভাইরাস ও বিতর্কের আবহে পিছনে ঠেলে উদ্বোধনের মতোই সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও আলোর রোশনাইয়ে ভাসল টোকিওর অলিম্পিক স্টেডিয়াম। বিভিন্ন দেশের অ্যাথলিটদের নানা রংয়ের আবেগ, উচ্ছ্বাস, ঐকান্তিকতায় সম্বৃদ্ধ হল এক ঐতিহাসিক সন্ধ্যা। অতিমারীর আবহে এক বছরের জন্য স্থগিত হয়ে যাওয়া যে মেগা ইভেন্ট সফলতার সঙ্গে স্বার্থক করে দেখিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল জাপান। প্রতিবন্ধকতার বাধা ঠেলে আয়োজিত হওয়া এই অলিম্পিককেই সর্বকালের সফলতম অলিম্পিক বলে আখ্যা দিল আইওসি। জাঁকজমকহীন অনুষ্ঠান হলেও চোখধাঁধানো আতসবাজি ও আলোর রোশনাই দেখা গেল। টোকিওর প্রতীক ইন্ডিগো বা নীলের সঙ্গে সাদা, এই দুটি রঙেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা গিয়েছে। আলোর খেলায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অলিম্পিকের পাঁচ চাকতির প্রতীক। পরিবেশিত হয়েছে জাপানের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির নানা ধারা। বিশ্বের দরবারে নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন স্থানীয় শিল্পীরা। প্রোজেক্টরেও ফুটিয়ে তোলা হয় জাপান। অলিম্পিকের ইতিহাস ও পরম্পরার সঙ্গে জাপান সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক অপরূপ ভাবনার প্রতিফলন দেখল বিশ্ব। যার উপজীব্যই হল মসৃণ, উজ্জ্বল ভবিষ্যত, সংহতি ও শান্তি।
ভারতের পতাকা হাতে বজরং
টোকিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতে দেশকে ইতিমধ্যেই গর্বিত করেছেন যে বজরং পুনিয়া, প্রতিযোগিতার সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তিনি পালন করলেন গুরুদায়িত্ব। দেশের তেরঙা হাতে মার্চে অংশ নিলেন ভারতীয় কুস্তিগীর। পিছু পিছু দৌড়ে এসে মাঠ ভরালেন রবিকুমার, দীপক পুনিয়ারা। সফলতা-ব্যর্থতার সুখ-দুঃখ ভুলে চওড়া হাসি ছিল সবার মুখে অমলিন। বিশ্বমঞ্চে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সম্মান যে কত বিরাট, তা প্রতিযোগিতার ব্যাপকতায় হয়তো টের পেয়েছেন সকলে। নিজ নিজ দেশের পতাকা ও শ্যুট গায়ে হাসিখুশি মেজাজে টোকিও অলিম্পিকের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গন আলোকিত করতে দেখা গিয়েছে অন্যান্য দেশের অ্যাথলিটদেরও।
দর্শক ছাড়াই অনুষ্ঠান
করোনা ভাইরাসের আবহে দর্শক শূন্য স্টেডিয়ামেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল টোকিও অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। একই নিয়ম বজায় থাকল সমাপ্তির প্রাঙ্গনেও। প্রতিযোগিতা চলাকালীন অলিম্পিকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা তিনশো পেরিয়েছে। তাতে গেমসের চলন কোনও বাধা আসেনি। অতিমারীর আবহে প্রশাসনের নির্দেশ মেনে কড়া বিধিতে নিজেদের আটকে রেখেছিলেন অ্যাথলিটরাও। তাই গেমসের সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও কোভিড প্রোটোকল মেনে মুখে মাস্ক পরেই টোকিওর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে দেখা যায় অ্যাথলিটদের। অতিমারীর আবহে সাবধনতা অবলম্বনে ফাঁকা রাখা হয় দর্শকাসনও। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা, আইওসি প্রধান থমাস বাচদের মতো অতিথিরা ছাড়া বিশেষ দিনে আর কাউকে স্টেডিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
সমাপ্তি অনুষ্ঠানে পদক প্রদান
অতিমারীর আবহে ১৬ দিন ধরে চলা টোকিও অলিম্পিকে অনেক নতুন বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। নতুনত্বের ছোঁয়া পাওয়া গেল প্র্রতিযোগিতার সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে এই প্রথম শেষ দিনের অনুষ্ঠানে জয়ী অ্যাথলিটদের পুরস্কার প্রদানও করা হল। পুরুষ ও মহিলাদের ম্যারাথনের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে থাকা অ্যাথলিটদের পদক পরিয়ে সম্মান জানালেন অতিথিরা। টোকিও অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল বিশ্বের ২০৫টি দেশ। ৯৩টি রাষ্ট্রের অ্যাথলিটরা বিশ্বের সেরা ক্রীড়াযজ্ঞ থেকে পদক জিততে সক্ষম হয়েছেন। পদক জয়ের নিরিখে তালিকার শীর্ষে স্থানে থাকল আমেরিকা (১১৩)। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে যথাক্রমে চিন (৮৮) ও জাপান (৫৮)। একটি পদক সহ মোট সাতটি পদক নিয়ে তালিকার ৪৮তম স্থানে অবস্থান করছে ভারত। সদ্য শেষ হওয়া টোকিও গেমসে মোট ৩৩টি ক্রীড়ার ৩৩৯টি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের ১১০৯০ জন অ্যাথলিট।
|
প্যারিসের হাতে ব্যাটন
২০২৪ সালে প্যারিসে বসবে ৩৩তম অলিম্পিয়াডের আসর। টোকিও গেমসের সমাপ্তি অনুষ্ঠান থেকেই আগামী অলিম্পিকের শুরুর অপেক্ষা শুরু হল। রীতি মেনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্যারিসের মেয়র আনে হিদালগোর হাতে তুলে দেওয়া হল অলিম্পিকের পতাকা। বেজে উঠল ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত। সঙ্গে জায়ান্ট স্ক্রিনে চলতে থাকা চলচ্চিত্রায়ণে ধরা পড়ল প্যারিস গেমসের আগমনীর আবহ। অলিম্পিকের আসর বসাতে তৈরি ফ্রান্স, জানিয়ে দিলেন সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এই প্রথম অলিম্পিকের পতাকা হস্তান্তরের সময় পরবর্তী আয়োজক দেশের জাতীয় সঙ্গীতের চলচ্চিত্রায়ণে তৈরি হল ইতিহাস। সেই আবহে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল পাঁচ মহাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে পাঁচ সফল অ্যাথলিটকে। পাঠ করা হল শপথ বাক্য। স্টেডিয়ামের এক কোণে জ্বলতে থাকা ঐতিহ্যবাহী মশাল অলিম্পিকের পরম্পরাকেই বহন করল।
আরিগাতো
সবশেষে মঞ্চে বিদায় সম্ভাষণ জালানে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রধান থমাস বাচ। যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ৩২তম অলিম্পিয়াডের সমাপ্তি টানলেন। দুর্যোগ ও প্রতিবন্ধকতার আবহে টোকিওয় অনুষ্ঠিত হওয়া অলিম্পিকই যে সর্বকালের সেরা, তা সরাসরি জানালেন বাচ। অতিমারীর আবহে যে বীরত্বের সঙ্গে জাপান প্রতিযোগিতা সফলভাবে আয়োজন করে দেখিয়েছে, তাতে তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন আইওসি প্রধান। সবশেষে জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন বাচ। ধন্যবাদ জানালেন আয়োজক কমিটিকে। বিশ্বকে আরিগাতো অর্থাৎ বিদায় জানাল টোকিও।