হারেও যখন জয়
১৩টি সেলাই। চোখের কাছে গালে সাতটি সেলাই, কপালে আরও ৬টি। এই ১৩টি সেলাই থাকায় সতীশ কুমারের এদিন কোয়ার্টার ফাইনাল বাউটে নামা নিয়েই ছিল সংশয়। কিন্তু চিকিৎসকদের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পেতেই সতীশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে যান শেষ অবধি লড়াই চালানোর জন্য। বুলন্দশহরের ছেলে, সেনাবাহিনীর সুবেদার মেজর ৩২ বছরের সতীশের এই ইস্পাতকঠিন মানসিকতার পিছনে সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকার বিষয়টি যে চালিকাশক্তির ভূমিকা নিয়েছে তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন উজবেক বক্সার বাখোদির জালোলোভের আমনে-সামনে হতে দু-বার ভাবেননি, পিছিয়েও যাননি চোট থাকা সত্ত্বেও। জালোলোভের কাছে আগেও তিনি দুবার হেরেছিলেন, এদিনও হারলেন ০-৫ ব্যবধানে। বাউট শেষের আগে মুখের ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোল রক্তও।
বেজে চলেছে ফোন
অলিম্পিকের কোয়ার্টার ফাইনালে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের কাছে হার, তাও আহত অবস্থায় লড়ে, এটাই তাই সতীশের কেরিয়ারের সেরা দিন হয়ে রইল। সে কারণেই তাঁর ফোন লাগাতার বেজেই চলেছে। ফোন তুললেই ওপার থেকে ভেসে আসছে অভিনন্দন-বার্তা। সে কথা জানিয়ে দেশের নয়া অলিম্পিয়ান সতীশ কুমার যাদব বলেন, সকলে এমনভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছেন যেন আমি-ই জিতেছি। আমার মুখে ক্ষত অংশগুলি কী মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে তা আমিই জানি। ওষুধও চলছে। প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে জিতলেও সেই বাউটের হেড বাটের কারণেই মুখের ওই অংশগুলি কেটে গিয়েছিল। সেলাইয়ের সঙ্গে চলছে পেইন কিলারও। সতীশের কথায়, নিজেকে বুঝিয়েছিলাম পরিস্থিতি যা-ই হোক লড়ব। না লড়লে সেই আক্ষেপ আজীবন থাকত। এখন অন্তত এটা ভেবে নিজে কিছুটা তৃপ্তি পাব যে, পিছু না হঠে আমি আমার সেরাটাই দিয়েছিলাম রিংয়ে।
পরিবারের আপত্তি
সতীশের অমন চোট থাকায় রিংয়ে না নামতে বারবার অনুরোধ করেছিল পরিবার, শোনেননি সেনাবাহিনী থেকে অলিম্পিকের আসরে যাওয়া সতীশ। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী এবং বাবা বারণ করেছিলেন রিংয়ে নামতে। বাবা এটাও বলেন, এই চোট নিয়ে আমি যে খেলছি সেটা দেখা তাঁর পক্ষে সহ্য করার মতো নয়। তবে পরিবার থেকে এমন বারণ করার কথাই স্বাভাবিক, তাঁরা কেউই চান না আমি আহত হই। কিন্তু আমি কেন লড়াই থেকে সরতে চাইনি সেটা পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা, দুজনেই স্কুলে পড়ে একজন ক্লাস ওয়ান, আরেকজন টু-তে। তারাও আজ টিভিতে বাবার খেলা দেখেছে। সতীশের আশা, সন্তানরাও নিশ্চয়ই গর্বিত হয়েছে তাঁর খেলা দেখে।
জালোলোভের প্রশংসা
কমনওয়েলথ গেমসে রুপোজয়ী, এশিয়ান গেমসে দুবারের ব্রোঞ্জজয়ী অনেকবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সতীশ জানিয়েছেন জালোলোভের বিরুদ্ধে তাঁর খেলার অভিজ্ঞতার কথাও। তিনি বলেন, বাউটের পর জালোলোভ নিজে আমার কাছে এসে বলেন খুব ভালো বাউট হয়েছে। যেভাবে আমি লড়াই করেছি তা জেনে-বুঝে জালোলোভ যে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেটা ভালো লাগছে। আমার কোচেরাও জানিয়েছেন তাঁরাও খুবই গর্বিত। আমি যে এতটা চালিয়ে যেতে পারব তাঁরাও ভাবেননি। উল্লেখ্য, বিশেষ করে তৃতীয় রাউন্ড চলার সময় বেশ ভালোই রক্ত ঝরছিল সতীশের মুখের ক্ষতস্থান থেকে। তাও শেষ অবধি রিংয়ে থেকে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। সতীশের ধারণা, অলিম্পিক বলেই এমন লড়াইয়ের পর এত অভিনন্দন-বার্তা আসছে। যা তাঁকে অবাকও করছে। তাঁর কথায়, পদক না পেলেও আমিও যেন সারপ্রাইজ প্যাকজ!
আত্মবিশ্বাসী সতীশ
দেশের প্রথম সুপার হেভিওয়েট বক্সার অলিম্পিকে। তাঁর এই বাউটের পর সংবাদমাধ্যমে প্রথম প্যারাগ্রাফে নাম থাকবে বুঝতে পেরেও বেশ মজা পাচ্ছেন সতীশ। তিনি বলেন, যা-ই হোক প্রথম প্যারায় তো আমার নাম এবার থাকবে। হেরে গেলেও এই বাউট আমাকে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস দিল। তবে এটাও ঠিক চোট না থাকলে হয়তো আরও ভালো লড়াই দিতে পারতাম। ভারতের পাঁচ পুরুষ বক্সারের মধ্যে একমাত্র সতীশই পৌঁছালেন শেষ আটে। যদিও বক্সারদের ব্যর্থতাদের মধ্যে সতীর্থদের পাশে থেকে তিনি বলেন, আমরা সকলেই কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পড়েছিলাম। কেউ বলতে পারবেন না আমাদের কেউ সহজ প্রতিপক্ষ পেয়েছিলেন। কেউই হারতে চান না। কিন্তু খেলায় জয়-পরাজয় থাকেই। আমরা সকলেই আরও শক্তিশালী হয়ে ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াব। কবাডি খেলোয়াড় ছিলেন। সেনাবাহিনীর কোচের পরামর্শে বক্সিংয়ে আসা। সতীশ ভবিষ্যতেও এমন চোট থাকলেও পিছপা হবেন না রিংয়ে নামতে। তাঁর কথায়, খেলোয়াড়দের কোনও অবস্থাতেই ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা দেখানো চলে না। লড়াই করতেই হয়, হবেও।