সুমন ভট্টাচার্য : এক্সিট পোল যদি কোনও পূর্বাভাস দেয়, তাহলে সেটা বিজেপির জন্য কি বার্তা বহন করছে? যদি বিষয়টাকে উল্টোদিক থেকে দেখা যায়, অর্থাৎ যেভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলা দখলকে ‘পাখির চোখ’ করেছিলেন, তাতে শ্যামাপ্রসাদের রাজ্য যদি একজন গেরুয়া মুখ্যমন্ত্রী না পায়, তাহলে সেটাই চরম বিরম্বনা। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী টানা প্রায় দেড়মাস ধরে যে রাজ্যে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেন, সেই রাজ্যের এক্সিট পোল কেন গেরুয়া শিবিরের দিকে ঢলে যাওয়ার ইঙ্গিত নেই? যে ভোটে রোজ আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা কেন্দ্রের কোনও হেভিওয়েট মন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন দেখতে অভ্যস্থ ছিলাম, শেষ তিন দফায় সেই সব তারকারা কোথায় উধাও হয়ে গেলেন?
এটা ঠিক এক্সিট পোল মানে ফলাফল নয়। এবং এটাও ঠিক, বিহারে এক্সিট পোলের পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণিত করে বিজেপি এবং নীতিশ কুমারের জোটই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক্সিট পোল সম্পর্কে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের নেতাদেরও এই অদ্ভুত ‘নিস্ক্রিয়তা’ নজর কাড়ে বটে! তাহলে কি বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ঠিক? মোদী-অমিত শাহের রথের চাকা পশ্চিমবাংলায় আটকে যেতে পারে, এইরকম সম্ভাবনা এখনও গেরুয়া শিবির ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না? এক্সিট পোলের ফলাফল যে কেন্দ্রের শাসক দলকে বেশ অস্বস্তিতে রেখেছে, সেটা অবশ্য তাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই পরিষ্কার। যেহেতু কোনও এক্সিট পোলই বিজেপি দুশো আসন পেতে পারে এমন কোনও সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে না, তাই অমিত শাহর দাবির তালিকায় আরও একটি ব্যর্থতার পালক জুড়তে চলেছে কি না, সেই নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
আসলে এবারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে যে উচ্চতায় বা যে মাত্রায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে দুশো আসন পাওয়া বা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কম কিছু হওয়াটা পরীক্ষায় ডাহা ফেলের সমানুপাতিক হবে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন বিজেপি যে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল এবং সেখান থেকে যে চমকপ্রদ উত্থান হচ্ছে, এটা কারোর মাথাতেই থাকবে না। ‘পশ্চিমবঙ্গে চাই বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী’ এটাই এই ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল লিগে বা আইপিএলে মিনিমাম আস্কিংরেট হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: চার্টার্ড ফ্লাইটে বিজেপি নেতাদের আগমন, দিল্লিতে অক্সিজেনের হাহাকার: দেশ-বিদেশ সবই দেখছে
কৃষক বিক্ষোভ, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে জেরবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হয়তো পশ্চিমবঙ্গ জয়কেই তাদের সেরা ট্রফি হিসেবে তুলে ধরতে ব্যগ্র ছিলেন। সেই ব্যগ্রতা বা পশ্চিমবঙ্গকে বেশি সময় দেওয়াই গোটা দেশে কোভিড পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর দিকে যাচ্ছে, অক্সিজেনের সঙ্কট কতটা তীব্রতর হচ্ছে, সেই দিকে প্রধানমন্ত্রী নজরকে যেতে দেয়নি বলে ইতিমধ্যেই বিরোধীরা অভিযোগ করেছে। শুধু বিরোধীদের অভিযোগ নয়, গোটা বিশ্বের সংবাদপত্রে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রীত্ব কড়া সমালোচনার মুখে পরেছে এই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে ব্যর্থতার অভিযোগকে কেন্দ্র করে।
কিন্তু যার জন্য এই গোটা বিশ্বজুড়ে সমালোচনা, গোটা দেশের এত নিন্দেমন্দ, সেই পশ্চিমবঙ্গ কি তাহলে বিজেপির কাছে অধরা মাধুরী-ই রয়ে যাবে? এখনও পর্যন্ত এক্সিটপোলের ইঙ্গিত কিন্তু সেই দিকেই। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পরাজয় মোদী-শাহ জুটির ভাবমূর্তিতে শুধু ধাক্কা দেবে না, গোটা ভারতবর্ষে বিরোধী আন্দোলনকে নতুন চেহারা দিতে পারে। নরেন্দ্র মোদী এতদিন যে বিষয়টা নিয়ে নিশ্চিত ছিল, যে সর্বভারতীয় স্তরে তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তার পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিজয়রথকে ঠেকিয়ে দিলে পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিউক্লিয়াস করে বিজেপি-বিরোধী জোট যে দানা বাঁধতে শুরু করবে, এই নিয়ে অন্তত কোনও সংশয় থাকার দরকার নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে সামলাতে জেরবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে সেটা একটা নতুন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ হতে পারে। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর যাই হোন রাহুল গান্ধীর মতো নির্লিপ্ত বসে থাকবেন না, তিনি তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব, আরবিন্দ কেজরিওয়াল, শরদ পাওয়ার, উদ্ধব ঠাকরে এবং তামিলনাড়ুতে জিততে চলা স্ট্যালিনদের সঙ্গি করে প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে যাবে।
এক্সিট পোলের পূবার্ভাস তাই শুধু অমিত শাহ দাবির অসারতার দিকে ইঙ্গিত করে না, ভবিষ্যতের এক অন্য রাজনৈতিক সমীকরণের কথা বলে। এবং বাঙালি হিসেবে আমরা অন্তত শ্লাঘাবোধ করতেই পারি, যে আরএসএস-বিজেপি বিরোধী সর্বভারতীয় রাজনীতির চুম্বক বিন্দুতে পরিণত হবেন একজন বাঙালি মহিলা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন সেটা বোধহয় এর আগে তাঁর দলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইট করে ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছিলেন। মহুয়ার ইঙ্গিত ছিল আগামী দিনে মমতাই নরেন্দ্র মোদীকে বারাণসীতে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। মহুয়ার ইঙ্গিত বাস্তবের চেহারা নিয়ে নিতে পারে, যদি মোদী-শাহের এই তীব্র আক্রমণকে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে রুখে দিতে পারেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে জাতীয় চেহারা দিতে বিজেপির কত নেতা, কত পাইক বরকন্দাজ, কত চার্টার্ড ফ্লাইট বা হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছিল। সিবিআই-ইডি তো দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বিরোধীদের হয়রান করে বলে অভিযোগ। তাই কেন্দ্রীয় এজেন্সি শুধু নয়, কত অর্থ এবং লোকবল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের এই ভোটে ব্যবহার করেছে, তা যেন আমরা ভুলে না যাই।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.