ইচ্ছাশক্তিতেই আইপিএল অভিষেক, রাস্তা মোটেই মসৃণ ছিল না দিল্লি ক্যাপিটালসের পেসারের

চেতন সাকারিয়ার পর গুজরাটের আরও এক ক্রিকেটারের আইপিএল অভিষেক। তাঁর জীবনের চলার পথটাও একেবারেই মসৃণ নয়। অনেক উত্থান-পতন পেরিয়ে ২৯ বছর বয়সে আইপিএল অভিষেক। যদিও পরের ম্যাচেই ফের বাদ পড়েছেন। তবে দমে যাওয়ার পাত্র নন লুকমান মেরিওয়ালা। দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে লাগাতার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীদের তালিকায় প্রথম দিকেই থাকেন বরোদার এই পেসার। আইপিএলের আসরে নিজেকে আরও ক্ষুরধার করতে চান। সুযোগ পেলে বল হাতে ম্যাজিকও দেখাতে বদ্ধপরিকর।

ক্রিকেট ছেড়ে ওয়েল্ডিং

গুজরাটের ভারুচ জেলার সরনার গ্রামের বাসিন্দা লুকমান। জন্ম মাকনে। তবে সরনাতেই তাঁর ক্রিকেট খেলা শুরু। অনূর্ধ্ব ১৪ অবধি বয়সভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেললেও বরোদা দলে জায়গা হচ্ছিল না। সংসারের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না। তাই সংসারের প্রয়োজনেই ১৪ বছর বয়সে ক্রিকেট ছেড়ে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শুরু করেন। লুকমান এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও বলেছেন, আমার বাবা ছোটোখাটো কৃষক। পরিবারের আয়-রোজগার তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি ছিল না। পরিবারে আমরা পাঁচ জন সদস্য ছিলাম। ক্রিকেটেও কিছু হচ্ছিল না বলে পরিবারের কথা ভেবেই ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শুরু করি। যদিও বাবা-মা আমাকে ক্রমাগত বলতে থাকেন ক্রিকেটে ফেরার জন্য। এরপর আমার এক কাকার সঙ্গে বরোদায় যাই। তিনি বলেছিলেন, ভালো করে খেলো। বরোদা দলে সুযোগ পাবেই।

সুযোগের সদ্ব্যবহার

নিজের সেরাটা দিয়ে খেলতে খেলতেই এসে গেল বরোদার অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ। ২০১৩ সালেই বিজয় হাজারে ও সৈয়দ মুস্তাক আলি টি ২০-তে অভিষেক। ২০১৩-১৪ বরোদা সৈয়দ মুস্তাক আলিতে চ্যাম্পিয়ন হয়, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী ছিলেন লুকমান। বাঁহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার লুকমানের বোলিং আরও সমৃদ্ধ হয় বরোদা দলেই ইরফান পাঠানের পরামর্শ পেয়ে। বাউন্সার ও ইয়র্কারে আরও দক্ষতা বাড়ে লুকমানের। ২০১৭ সালে হয় রঞ্জি অভিষেক। ১৭টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ৫৯টি উইকেট রয়েছে তাঁর। ঘরোয়া ওয়ান ডে টুর্নামেন্টে ৩৬ ম্যাচে ৪৭ উইকেট। টি ২০-তে ৪৫ ম্যাচে ৭৩টি উইকেট। এ বছর সৈয়দ মুস্তাক আলি টি ২০-তে ৮ ম্যাচে ১৫ উইকেট নেন। ইকনমি ৬.৫২, সেরা বোলিং আট রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট। সেমিফাইনালে পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে ৩ উইকেট নেন ২৮ রানে। ফাইনালে বরোদা হারলেও তামিলনাড়ুর তিনটি উইকেটের মধ্যে একটি লুকমানের। বিজয় হাজারে ট্রফিতেও ৮ উইকেট নেন। তার মধ্যে গুজরাট, হায়দরাবাদ ও গোয়ার বিরুদ্ধে ২টি করে উইকেট নেন।

মহা চিন্তায়

ক্লাস নাইনের বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই আইপিএলে ২০ লক্ষ টাকার বেস প্রাইসে দিল্লি ক্যাপিটালস তাঁকে নেওয়ার পর চিন্তায় পড়েন লুকমান। কোচ রিকি পন্টিংয়ের ইংরেজিতে কথা বুঝতে অসুবিধা হবে যে! যদিও তাঁর এই চিন্তা কাটাতে অনেকটাতেই সহযোগিতা করেন আরেক প্রাক্তন ভারতীয় পেসার মুনাফ প্যাটেল। ঘরোয়া ক্রিকেটের দুরন্ত ছন্দ দিল্লি ক্যাপিটালসের নেটেও ধরে রাখেন লুকমান। তাই পাঞ্জাব কিংস ম্যাচের পর যখন তাঁকে প্রশ্ন করা ইশান্ত শর্মা বা উমেশ যাদবদের না খেলিয়ে কেন লুকমানকে খেলানো হলো, সেই প্রশ্নের উত্তরে রিকি পন্টিং বলেছিলেন, নেটে যেভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন লুকমান সেই নিরিখেই তাঁকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

ছবি- দিল্লি ক্যাপিটালস

অভিষেক অমসৃণ

আইপিএল অভিষেকও তাঁর কেরিয়ারের মতো মসৃণ হয়নি। ক্রিস ওকস বল করার সময়ই তাঁকে ঋষভ পন্থ বলেছিলেন, পরের ওভার বল করতে হবে। তিনি প্রস্তুত হন। পন্থ এসে বলেন, বিপক্ষে কে রয়েছেন বা কোন দলের বিরুদ্ধে খেলছো সে সব মাথায় রেখো না। বরোদার হয়ে যেমন বল করো তেমনটাই করে যাও। যদিও আইপিএলে প্রথম ওভারেই ২০ রান দিয়ে বসেন লুকমান। তবু তাঁকে আক্রমণ থেকে সরাননি পন্থ। পরের ওভারে এসে আট রান দেন। এরপর অশ্বিনের বলে দুবার মিসফিল্ড করায় ময়াঙ্ক আগরওয়াল চার পেয়ে যান। নীচু হয়ে বল ধরতে না পারায় বলটি বাউন্ডারি পেরিয়ে যায়। যদিও নিজের তৃতীয় ওভারে তথা ম্যাচের ১৩তম ওভারে মাত্র চার রান দেন এবং ময়াঙ্কের উইকেট তুলে নেন। রাহুল-ময়াঙ্কের ১২২ রানের জুটি ভাঙার পরই দিল্লির নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে পাঞ্জাবের রান তোলার গতি কমে।

ছবি- বিসিসিআই/আইপিএল

শিখতে চান

লুকমানের আইপিএল অভিষেকে খুশি হার্দিক ও ক্রুণাল পাণ্ডিয়াও। তাঁরা তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। যদিও গতকাল মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে অবশ্য প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়েন লুকমান। চিপকের ঘূর্ণি উইকেটে বাজিমাত করেন অমিত মিশ্র। তবু হাল ছাড়তে নারাজ লুকমান। তিনি জানিয়েছেন, ইশান্ত, উমেশদের থেকে শিখতে চান। নেটে নামি তারকাদের বিরুদ্ধে বোলিং করেও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিতে চান। আইপিএলে সুযোগ এলেই ঘরোয়া ক্রিকেটের ছন্দে ফিরতে বদ্ধপরিকর লুকমান। এরই মধ্যেই আবেগঘন এই পেসার জানান, পাঞ্জাব ম্যাচের দিন তাঁর মেয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, পাপা তুমি কি আজ খেলছো? ম্যাচের পর দিল্লি ক্যাপিটালসের পোস্ট করা ভিডিওতে লুকমান বলেন, মেয়েকে বলতে পারবো খেলেছি এবং জিতেওছি।

ছবি- বিসিসিআই/আইপিএল