সুমন ভট্টাচার্য: বাঙালির নববর্ষ ‘হিন্দু নববর্ষ’ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নাকি মার্ক জুকেরবার্গও খুব চিন্তায় রয়েছেন কবে তাঁর ফেসবুকও হিন্দু সামাজিক মাধ্যম হয়ে যাবে।

এমনিতে ইতিহাসকে গুলিয়ে দেওয়া যেহেতু বিজেপি এবং গেরুয়া শিবিরের পুরানো অভ্যেস, তাই বাঙালির নববর্ষকে এইভাবে হিন্দু নববর্ষ প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর বিজেপি নেতৃত্বকে দেখে কৌতুক অনুভব করা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই। কেন কৌতুক? কারণ, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে যেহেতু মুঘল সম্রাট আকবরের একটা সম্পর্ক আছে, তাই সেটা গেরুয়া শিবিরের প্রবল অপছন্দের কারণ। গেরুয়া শিবির বা সংঘ পরিবার যেহেতু মুঘল আমলকে অস্বীকার করতে চাই, তাই মাঝে মধ্যেই তাজমহল নিয়েও নানা অদ্ভুত দাবি পেশ করা হতে থাকে, যার সঙ্গে ইতিহাস বা ঐতিহাসিক তথ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। ‘তাজমহল আসলে শিবমন্দির ছিল’ এই সব কল্পিত ধারনা পোষণ করা গেরুয়া শিবিরের নেতারা পারলে তাজমহল কিংবা মুঘল শাসনের পর্বটাকেই ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চান। আরএসএস-এর যে কোনও তত্ত্বের ভিতরে বা গেরুয়া শিবিরের ইতিহাস এবং রাজনীতিকে দেখার বিষয়ে যে তীব্র ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ কাজ করে, এটা আসলে তারই আর একটা বহি:প্রকাশ।

কিন্তু তাজমহল নিয়ে বিভিন্ন আজগুবি গল্প বাজারে ছাড়ার পরও গেরুয়া শিবিরের ‘পোস্টারবয়’ বা ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজেকে সর্বদা তুলে ধরতে ব্যগ্র যোগী আদিত্যনাথকে ভারত সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে তাজমহলের ছবি হাসি হাসি মুখে তুলে দিতে হয়। কিংবা উত্তরপ্রদেশের সাফল্য বা শিল্পায়নের খতিয়ান ব্যাখ্যা করতে গেলে যোগী আদিত্যনাথকে যে সব হস্তশিল্পের কথা বলতে হয়, সেগুলির সঙ্গে মূলত মুসলিম কারিগররাই জড়িয়ে আছে।

ভারতবর্ষে মুসলমানদেরকে কিভাবে দেখবে এবং কিভাবে তাদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করা হবে, সেটা যেহেতু আরএসএস বা গেরুয়া শিবির বুঝতে পারে না, তাই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এরকম দোলাচলে ভোগে। ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’-এর যে তত্ত্বে গেরুয়া শিবির অনড়, সেখানে বহু মাত্রিক ভারতবর্ষ বা তার সমাজব্যবস্থার কোনও উল্লেখ নেই। সেখানে গেরুয়া শিবির কোনও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বকেই স্বীকার করতে চায় না। সেখানে শুধু মুসলমান বিদ্বেষ নেই, আরএসএস খ্রিষ্টানদের অস্তিত্ব বা ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় তারা যে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে, সেটাকেও ভুলিয়ে দিতে চায়। সেই কারণেই গোটা দেশ যখন ২৫শে ডিসেম্বরকে বড়দিন বা যীশুর জন্মদিন হিসাবে উদযাপন করে, এবং এটা একটা সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়, তখন প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে আরএসএস বড়দিনের প্রতিস্পর্ধী হিসাবে ২৫শে ডিসেম্বরকে তুলসীপুজোর দিন হিসাবে উদযাপনের ডাক দেয়।

তার কারণ আরএসএস বা গেরুয়া শিবির শুধু মুসলিম না, খ্রিষ্টানদেরও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে ভারতীয় সমাজে স্বীকার করতে চায় না।

সেই কারণেই বাংলা নববর্ষ, যেটা ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে বাঙালির নববর্ষ এবং যেটা এই বঙ্গে চালু করার পিছনে অবশ্যই সম্রাট আকবরের ভূমিকা রয়েছে, সেটাকে গেরুয়া শিবির হিন্দু নববর্ষ বলে গুলিয়ে দিতে চায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছিলাম, আমেরিকা প্রবাসী বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী, যিনি ওয়াশিংটনের জন হফ কিংস বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয় গবেষণা করছেন, সেই পর্ণালী ধর চৌধুরী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ট্যুইটকে উদ্ধৃত করে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাইডেন কিন্তু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন। এবং শুভেচ্ছা বার্তায় বাঙালির নববর্ষের উল্লেখ আছে, কোনও ‘হিন্দু নববর্ষ’ এর প্রসঙ্গ নেই। পর্ণালী এটা করতেই পারেন, কারণ, তিনি নিজেকে জো বাইডেনের সমর্থক বলে চিহ্নিত করেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডেমোক্রাট প্রার্থী হিসাবে বাইডেন যখন প্রচার করছিলেন, তখনও তাঁর সঙ্গে পর্ণালীর ছবি দেখা গিয়েছিল।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আপামর বাঙালি যেটা জানে, গোটা বিশ্ব যেটাকে বাঙালির নববর্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, সেটাকে গেরুয়া শিবিরের ধর্মের রং লাগাতেই হবে। তার কারণ ধর্মীয় মেরুকরণ ছাড়া সংঘ পরিবার বা বিজেপির এই মুহূর্তে রাজনীতিতে খুব বেশি কিছু নেই। পেট্রোল, ডিজেলের দাম, গ্যাসের দাম কিংবা ব্যাঙ্কের কমতে থাকা সুদ, যেগুলির সাথে সাধারণ মানুষের বেশি স্বার্থ জড়িত, সেখানেই হিন্দু শব্দ নিয়ে খুব আলোচনা করতে চায় না কেন্দ্রের শাসক দল। কারণ তাহলে নিজেদের দিকেই অনেক প্রশ্ন ধেয়ে আসবে। সেইগুলিকে পাশ কাটিয়ে বাঙালিকে হঠাৎ করে নতুন কিছু বোঝানোর জন্য ‘হিন্দু নববর্ষ’ বাজারে ছেড়ে দেওয়া ভালো।

বাঙালির নববর্ষে সকালে কালিঘাটে পুজো দেওয়া আছে, ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধির জন্য লক্ষ্মী-গণেশকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণও আছে। তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু মিলিয়ে এটা একান্তভাবেই বাঙালির উৎসব। সেই কারণেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেও যখন নববর্ষ উৎসব হয়, সেটা ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে পেরিয়ে অন্য মাত্রা দেয়। ঢাকার রাস্তায় যে মিছিল হয়, তাকে ‘মঙ্গলযাত্রা’ বলা হয়।

বাঙালির এই ঐতিহ্য বা ইতিহাসকে যেভাবে অস্বীকার করছে গেরুয়া শিবির, সেটাই হয়তো জুকেরবার্গের ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপকেও কোনওদিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে। বলা হবে এটাও মহাভারতের সময় থেকে চলে আসা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।

লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'! 'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.

করোনা পরিস্থিতির জন্য থিয়েটার জগতের অবস্থা কঠিন। আগামীর জন্য পরিকল্পনাটাই বা কী? জানাবেন মাসুম রেজা ও তূর্ণা দাশ।