বেকারত্বের হাহাকার, বাংলায় চলা বিধানসভা ভোটের মাঝে মালদা ছাড়ছেন বহু শ্রমিক

করোনা ভাইরাস মহামারি ও লকডাউনের আতঙ্কে যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা কর্মস্থান ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসছেন, সেখানে এই মহামারির মধ্যেও পেটের জন্য বাংলা ছাড়ছেন শ্রমিকরা। ৩১ বছরের বিবেক মণ্ডল, পেশায় নির্মাণ কর্মী বলেন, '‌আমার ভয় লাগছে করোনা ভাইরাস থেকে, কিন্তু আমার পেট কাঁদছে, আমি কি করব?‌’‌

ফারাক্কা এক্সপ্রেস

৩১ বছরের বিবেক মালদা স্টেশন থেকে ফারাক্কা এক্সপ্রেসে করে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সপ্তাহে চারদিন সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ফারাক্কা এক্সপ্রেস মালদা স্টেশন থেকে ছাড়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে। তবে এই ট্রেনটি বর্তমানে বিশেষ হয়ে ওঠার পিছনে কারণ হল শত শত বাংলার শ্রমিক কাজের অভাবে মালদা ছেড়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন। জাতীয় রাজধানীতেই পেটের ভাত জোটাতে কাজ খুঁজে নেবেন তাঁরা।

করোনা আতঙ্কেও ঘরছাড়া শ্রমিক

এই ট্রেনের কিছু শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছে এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম, যাঁর এই ট্রেনকে ‘‌শ্রমিক ট্রেন'‌ বলে অ্যাখা দিয়েছেন। মালদা স্টেশনে শ্রমিক ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করা হয় যে এই মহামারির মধ্যেও কেন তাঁরা তাঁদের নিজ রাজ্য ছাড়ছেন এবং যদি চাকরি ও বেকারত্বই কারণ হয় তবে বাংলায় চলা বিধানসভা নির্বাচনের পর কিছুটা পার্থক্য আসবে।

দ্বিতীয় ওয়েভের মধ্যেও কাজের সন্ধান

বিবেক মণ্ডল ভারতের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন এবং এখন দেশে দ্বিতীয় করোনা ওয়েভ চলছে। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন যে তাঁর কাছে দিল্লিতে ফিরে কাজের সন্ধান করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বিবেক বলেন, ‘‌২০২০ সালে লকডাউনের একমাস আগে আমি বাড়ি ফিরে আসি। গত এক বছর ধরে আমি মালদাতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করি, যাতে কোনও মতে আমার সংসার চলে। কিন্তু এখন আর্থিক সমস্যা বেড়ে গিয়েছে আর সে কারণে আমায় মালদা ছাড়তেই হচ্ছে। এই জন্য আমরা মাস্ক পরে বেরিয়ে পড়েছি।'‌ বিবেকের পাশেই ট্রেনে বসেছিলেন প্রফুল্ল মণ্ডল, যিনি দিল্লিতে নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রফুল্ল দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন স্কুলে কিন্তু তাও তিনি মালদাতে পর্যাপ্ত কাজ পাননি। তিনি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ছাড়েন এবং ২০১০ থেকে দিল্লি, কর্নাটক, কেরল ও অন্যান্য জায়গাতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন। প্রফুল্ল বলেন, ‘‌মালদায়, যদি আপনি শ্রমিক হিসাবে কাজ খোঁজেন তবে দিনে ২০০ টাকা উপার্জন করতে পারবেন। কিন্তু দিল্লিতে দৈনিক ৪৫০ টাকা পাওয়া যায়।'‌ টাকার এই পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রফুল্লর কাছে, কারণ তাঁকে পরিবারে টাকাও পাঠাতে হয়। ২৮ বছরের যুবকের অভিভাবক, স্ত্রী ও ২টো ছোট ছোট কন্যা সন্তান রয়েছে। করোনা বাইরাসের আতঙ্ক ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও প্রফুল্ল আর মালদাতে থাকতে কোনওভাবেই রাজি নন। তিনি বলেন, ‘‌আমরা যদি পরিশ্রম না করি তবে আমাদের জন্য এটি একটি বিশাল সমস্যায় পরিণত হবে।'‌ আর এক শ্রমিক বিবেক লামেন্ট বলেন, ‘‌আমি বুঝতে পারছি না মালদায় কেন পর্যাপ্ত কাজের অভাব রয়েছে?‌ যদি এখানে কাজ থাকত, তবে তো আমরা মালদা ছেড়ে যেতাম না?‌ রাজনৈতিক দলগুলি শুধু আমাদের ভোট নেওয়ার জন্য আসে, কিন্তু তারা চাকরি বা কাজ পাওয়ানোর কথা বলে না।'‌

বিজেপির ওপর আশা শ্রমিকদের

পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই চতুর্থ দফার বিধানসভা ভোট সম্পন্ন হয়েছে। আর চার দফা ভোট বাকি। এরই মধ্যে রাজ্যে কাজের অভাবে বিভিন্ন জেলার শ্রমিকরা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন। প্রফুল্ল এবং বিবেক উভয়ই আশাবাদী ছিলেন যে বাংলায় কর্মসংস্থান বাড়াবে বিজেপি যে কারণে তাঁরা ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে গেরুয়া দলকে ভোট দিয়েছিলেন। ফারাক্কা এক্সপ্রেস যখন ছাড়ার মুখে সেই সময় দুই বন্ধুই বলেন, ‘‌আমরা জানি না আদৌও তারা (‌বিজেপি)‌ কর্মসংস্থান তৈরি করবে কিনা, কিন্তু আমাদের আশা রয়েছে তারা করবে। যদি তারা সেটা না করে তখন আমরা কি করব?‌ আমাদের পরিশ্রম করেই বেঁচে থাকতে হবে?‌'‌ মালদায় যখন মার্চের শেষের দিকে ভোট হবে তখন এঁদের মধ্যে কেউই ভোট দিতে সক্ষম হবেন না, কারণ তাঁরা বাড়ি থেকে অনেক দূরে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকবেন।

কংগ্রেসের ঘাঁটি হিসাবে একসময় পরিচিত

রাজনৈতিক দিক দিয়ে মালদা বরাবরাই কংগ্রেসের ঘাঁটি হিসাবেই পরিচিত। মূলত জীবনের চেয়ে বৃহত্তর উত্তরাধিকারের কারণে কংগ্রেসের প্রাক্তন বরিষ্ঠ নেতা গনি খান চৌধুরি এই মালদা থেকে আটবার সাংসদ হয়েছেন। কিন্তু গনি খান চৌধুরি মারা যাওয়ার ১৫ বছর পরও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ক্রমাগত মালদায় কংগ্রেসের অবস্থানকে দখল করে রেখেছে, তবে এটিকে আর কংগ্রেসের দুর্গ বলা চলে না।

কংগ্রেস দুর্গের অবসান মালদায়

উদাহরণস্বরূপ বলা চলে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে মালদার দু'‌টি আসনের মধ্যে একটিতে কংগ্রেস জয়লাভ করে, বিজেপি উত্তর মালদার আসনে তিন দফা লড়াইয়ের পর জয় পায়। বিজেপি সেই সময় ৫.‌০৮ লক্ষ ভোট পেয়ে জিতেছিল, তৃণমূল পেয়েছিল ৪‌.‌২৫ লক্ষ ভোট এবং কংগ্রেসের ঝুলিতে ভোট ছিল ৩.‌দ৫ লক্ষ ভোট। এমনকী দক্ষিণ মালদার আসনে গনি খান চৌধুরির ভাই তথা কংগ্রেস প্রার্থী বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরিকে মাত্র ৯,৫৩৭ ভোটে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে অন্যান্য রাজ্যের মতোই এ রাজ্যে শুধুমাত্র বিজেপি-তৃণমূল লড়াই হলেও মালদায় ফের তিন দফা লড়াই হতে চলেছে, কংগ্রেস-সিপিএম-আইএসএফ জোট, বিজেপি ও তৃণমূল। এই তিনজনই আশা করে রয়েছে এই জেলা থেকে বিপুল পরিমাণ ভোট তারা পাবে।

কাজ নেই মালদায়

মালদার মানিকচক বিধানসভার অন্তর্গত নিমাতপুরের ৫০ বছরের বাসিন্দা শেখ জাহিররুল বলেন, ‘‌এখানে কিচ্ছু নেই। চাল কেজি প্রতি ২ টাকা করেই শুধু পাই আমরা।'‌ জাহিরুল তৃণমূল সরকারের কল্যামমূলক প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ২ টাকা প্রতি কেজি দরে চাল পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘‌যাঁরা এখানে রয়েছেন তাঁরা কাজের পর দৈনিক ২৫০ টাকা করে পান, গোটা মাস পরিশ্রম করার পর হাতে আসে ৭,৫০০ টাকা।' জাহিরুলের চার ছেলের মধ্যে তিনজনই হিমাচল প্রদেশে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। বিবেক মণ্ডলও বলেন, ‘‌না গেলে তো হবে না।'‌ তবে প্রশ্ন একটাই থেকে যাচ্ছে করোনা আবহের মধ্যে আদৌও এই শ্রমিকরা ভিন রাজ্যে গিয়ে কাজ খুঁজে পাবেন তো?‌ ‌

মালদা নিয়ে রাজ্য–কেন্দ্র কোন্দল

২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি রিপোর্টে মালদার ওপর এবং এই জেলার বেকারত্বের দাবি করে মানব উন্নয়ন সূচকে রাজ্যে জেলাভিত্তিক পরিমাপে মালদা সর্বশেষ স্থানে রয়েছে। বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকারের মধ্যে মালদার অনগ্রসর জাতিকে নিয়ে ঝামেলা বহু পুরনো। ২০১৮ সালে মোদী সরকার ভারতের সর্বোচ্চ পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করে, যেখানে মালদা সহ মূর্শিদাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুর, বীরভূম ও নদিয়া সহ দেশের ১১৫ টি জেলা তালিকাভুক্ত ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাশন তাতে রাজি হয়নি। কেন্দ্র চেয়েছিল যে এইসব জেলাগুলিতে কেন্দ্র সরকারের আধিকারিকরা গিয়ে উন্নয়নগুলি দেখে আসুক, কিন্তু রাজ্য সরকার তাতে নিমরাজি ছিল এবং প্রবল আপত্তি তুলে বলেছিল, ‘‌দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্র।'‌

বিধানসভা ভোটে কর্মসংস্থান মূল হাতিয়ার

২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় প্রচারে এসে বিজেপি তৃণমূলকে কটাক্ষ করে বারংবারই জানিয়েছে যে রাজ্যে যুব সম্প্রদায়ের জন্য কর্মসংস্থান নেই। এমনকী নরেন্দ্র মোদী এসেও জানান মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর তৃণমূল রাজ্যকে শিল্প ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত করেছে। তবে চুপ থাকেনি তৃণমূলও। মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-এর সেন্টার ফর ২০২০ সালের ডিসেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রতিক রাজ্য-বেকার পরিসংখ্যানকে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরে তৃণমূল যোগ্য জবাব দিয়েছে। এই পরিসংখ্যানে বাংলার বেকারত্বের হার মাত্র ৬ শতাংশ যেখানে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদে (‌১৪.‌৯ শতাংশ)‌ ও হরিয়ানা (‌৩২.‌৫ শতাংশ)‌-তে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। তবে কর্নাটক (‌১.‌৪ শতাংশ)‌ ও গুজরাতের (‌৩ শতাংশ)‌ চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলা।