সুমন ভট্টাচার্য: ‘রাজাকার’। ‘রাজাকারের পোলা’। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও আমাদের প্রতিবেশী দেশে এই শব্দদুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও আলোড়ন উঠে ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় কারা রাজাকার ছিল। অর্থাৎ কারা সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের মদত দিয়েছিল। অর্থাৎ ৫০ বছর বাদে বাংলাদেশে এখনও রাজাকার শব্দটি নিয়ে আলোড়ন হয় কারা সেই সময় বাঙালি জাতির পাশে ছিল, কারা বিরুদ্ধে ছিল।

শীতলকুচির ঘটনার পরেও পশ্চিমবাংলায় যে ভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা করা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের আক্রমণ এবং সামাজিক ভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে, তাতে ৫০ বছর বাদে এই সময়টাকে যখন কাটাছেঁড়া করা হবে, তখন না বিচার করা হয় কারা বাঙালিদের সঙ্গে ছিল, আর কারা বাঙালিকে জাতি হিসেবে আক্রমণের এবং ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। সেটা নিয়ে হয়তো ইতিহাস তুল্যমূল্য বিচার করবে।

শীতলকুচির ঘটনা এবং তারপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর একদিনের জন্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা অনেকেই অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেনের অন্যতম দুই উদ্যোক্তা চলচ্চিত্র পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় এবং প্রাবন্ধিক সুমন সেনগুপ্ত ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, কারা এই সময় বাঙালির বিরুদ্ধে ছিল, সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করছিল এবং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল, তা ইতিহাস মনে রাখবে। অনিকেত এবং সুমন যা বলেছেন তা আসলে সিএএ এবং এনআরসির সময় খুব জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া আমির আজিজের সেই গানটাই—‘সব কুছ ইয়াদ রাখ্যা জায়েগা’। যার অনুবাদ করে সারা ফেলে দিয়েছিলেন টলিউডের অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। নিজের বামপন্থী পরিচয় নিয়ে সদা গর্বিত অনির্বাণের অনুবাদের ক্যাচ লাইনটি ছিল—‘সব কিছু মনে রাখা হবে’।

অনিকেত এবং সুমন সেনগুপ্ত, ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেনের দুই মুখ। স্পষ্টভাবে যে কথাটা বলেছেন সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রত্যেককেই নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই লড়াইতে কে কোথায় আছে? কারণ বিজেপি যেভাবে পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজন করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে অবস্থান না নিলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। আসলে এই রাজনৈতিক লাইনটি এর আগেও সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতা এবং পিডিএস-এর প্রতিষ্ঠাতা সইফুদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন। বিরানব্বইয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেই তাঁর বক্তব্য ছিল, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সব দলকেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। কারা ধর্মনিরপেক্ষতার স্বপক্ষে এবং কারা ধর্মীয় মেরুকরণ পছন্দ করে। সেদিন সইফুদ্দিনের দল সিপিএম স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি।

বর্তমান ভারতবর্ষের রাজনীতিতে দাঁড়িয়ে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একই স্লোগান তুলেছেন। তিনিও বলেছেন বিজেপিকে প্রতিহত করতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে জেতাতেই হবে। দীপঙ্কর বিহারের নির্বাচনে তাঁর দল সিপিআইএমএলকে বামেদের মধ্যে প্রধান শক্তি হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং তাদের সহযোগী দলগুলি দীপঙ্কর ভট্টচার্যর রাজনৈতিক লাইনকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। কিন্তু শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালানো ও বিজেপি নেতাদের প্ররোচনামূলক বক্তৃতাকে ছাড় দিয়ে শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা আবার চার দফা ভোটের আগে রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব এবং কে কোথায় দাঁড়িয়ে, সেই নিয়ে আলোচনার নতুন পরিসর তৈরি করেছে।

সেই কারণেই ১৯৭১-এর বাংলাদেশে কারা বাঙালির স্বপক্ষে ছিল, এবং কারা বাঙালির বিরুদ্ধে, সেই নিয়ে আজও চলা রাজনৈতিক বিতর্কের প্রসঙ্গ টানলাম। এই ২০২১-এর মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগেও শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বাঙালি হিসেবে হয়তো আমাদের প্রত্যেককেই নিজেদের অবস্থান এবং দর্শনকে পরিষ্কার করতে হবে। আমরা ভারতবর্ষকে কীভাবে দেখতে চাই, বাঙালি হিসেবে কি প্রত্যাশা করি, বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে কতটা মনে রেখেছি, গণতন্ত্র রক্ষা এবং বিকাশের জন্য আমাদের কি অবস্থান। ইতিহাস, তাকে যেভাবেই লেখার চেষ্টা করা হোক না কেন, আজ থেকে ৫০ বছর বাদে এই ২০২১-এ প্রত্যেক বাঙালির অবস্থানকে বিচার করবে। এবং সেই বিচারের দায়ভার আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও বহন করতে হবে। ‘সব কিছু মনে রাখা হবে’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকায় যেভাবে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ কায়েম করার চেষ্টা হয়েছিল, এবং এই সেদিনও ডোনাল্ড ট্রাম্প অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির নামে মার্কিন গণতন্ত্রের যে সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন, তাকে যেমন ইতিহাস প্রতি মুহূর্তে মনে রেখেছে, হিটলারের সময় ইহুদিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে যে শ্বেতাঙ্গ ‘প্রভুত্ব’ কায়েম করার চেষ্টা হয়েছিল, সেগুলোর সবই নথিবদ্ধ আছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এবং হিন্দি আধিপত্যবাদকে কায়েম করার চেষ্টা ভবিষ্যতের ইতিহাস সেই ভাবেই বিচার করবে। শুধু নিজেকে প্রগতিশীল বলবো, কিন্তু আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো না, এটা কিন্তু হবে না।

কে জানে আজ থেকে ৫০ বছর বাদে ইতিহাস লেখার সময় তাহলে আমাদের গায়েও ‘রাজাকার’-এর তকমা লেগে যাবে কি না!

লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'! 'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.

করোনা পরিস্থিতির জন্য থিয়েটার জগতের অবস্থা কঠিন। আগামীর জন্য পরিকল্পনাটাই বা কী? জানাবেন মাসুম রেজা ও তূর্ণা দাশ।