ভাইয়ের অপমৃত্যু, অনটন পেরিয়ে আইপিএলে স্বপ্নের অভিষেক রাজস্থান রয়্যালস পেসারের

আইপিএল বদলে দেয় জীবন। সত্যিই! চেতন সাকারিয়ার কাহিনির দিকে চোখ রাখলে সেটা আরও একবার প্রমাণিত হয়। অদম্য জেদ আর পরিবারের আত্মত্যাগ চেতন সাকারিয়ার সাফল্যের নেপথ্যে। পাঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে গতকালের ম্যাচে রাজস্থান রয়্যালসের সেরা বোলার সৌরাষ্ট্রের পেসার চেতন সাকারিয়া। তাঁর ঝুলিতে ময়াঙ্ক আগরওয়াল, লোকেশ রাহুল ও ঝাই রিচার্ডসনের উইকেট। ষষ্ঠ ভারতীয় বোলার হিসেবে আইপিএল অভিষেকে তিন উইকেট। কিন্তু জানেন কি, এই চেতন সাকারিয়ার মতো প্রতিভাই হারিয়ে যেতে পারতেন। যদি না এগিয়ে আসতেন তাঁর মামা।

অভাবকে জয়

গুজরাটের ভাবনগরের এক অটোচালকের পুত্র চেতন সাকারিয়া। ছোটো থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অপরিসীম আগ্রহ। বাবা এক সময় তাঁকে বলেছিলেন, বড়লোকের খেলা ক্রিকেট আমাদের জন্য নয়। পড়াশোনা করো ভালোভাবে। যদিও সে কথা চেতনকে নিজের লক্ষ্যপূরণ থেকে সরাতে পারেনি, কমাতে পারেনি ক্রিকেটের প্রতি তাঁর প্যাশনকে। যদিও ১৭ বছর বয়সে ক্রিকেট মাঠেই চোট পেয়ে তাঁকে ৭-৮ মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়। অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে তাঁর ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। ভাবনগরেই চেতনের এক মামার পাইকারি স্টেশনারি দোকান রয়েছে। তিনি চেতনকে বলেন, আমার দোকানে পার্ট-টাইম কাজ করো। তোমার ক্রিকেটের যাবতীয় খরচ আমি বহন করব। সেই প্রস্তাবই হারিয়ে যেতে দেয়নি চেতন সাকারিয়ার মতো ক্রিকেট প্রতিভাকে। সৌরাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান চেতন। কোচবিহার ট্রফিতে ৬ ম্যাচে ১৮ উইকেট নেন। কর্নাটকের বিরুদ্ধে ৮৪ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, যার ফলে সৌরাষ্ট্র প্রথম ইনিংসে লিড পায়। এরপরই চেতনকে সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে পাঠায়।

ম্যাকগ্রার নজরে

এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনেই গ্লেন ম্যাকগ্রার নজরে পড়েন চেতন। ম্যাকগ্রাকে তিনি বলেছিলেন, যদি আমি ফিটনেস আর অ্যাকশন আরও উন্নত করতে পারি তাহলে আমার বলের গতি ঘণ্টায় আরও ৫ কিলোমিটার বাড়াতে পারি। ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার বেগে বল করতে পারলে অন্তত রঞ্জি দলে সুযোগ পাব। এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে যখন ট্রায়ালে যখন চেতন যান তার আগে অবধি তাঁর নিজের জুতো ছিল না। এমনকী সৌরাষ্ট্রর হয়ে যখন বয়সভিত্তিক দলেও খেলেছেন অন্যের জুতো চেয়ে। কারণ, অভাবের সংসারে চেতনকে জুতো বা ক্রিকেট কিট কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাঁর বাবার। চেতনের কথায়, শেল্ডন জ্যাকসন তখন আইপিএল খেলছেন। আমার কাছে তিনি বিশাল মাপের ক্রিকেটার। জ্যাকসন কেকেআরে যোগ দেওয়ার আগে অনুশীলন করতে নেটে ভালো বোলার খুঁজছিলেন। আমাকে তিনি বলেন, আমি তাঁকে আউট করতে পারলে তিনি আমাকে এক জোড়া নতুন জুতো দেবেন। নেটে বল করার পর জ্যাকসন আমাকে নতুন জুতো উপহার দেন, যা নিয়ে আমি এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে গিয়েছিলাম।

ছবি- বিসিসিআই/আইপিএল

আইপিএলের পথে

জয়দেব উনাদকাটের চোট চেতন সাকারিয়ার রঞ্জি অভিষেকের সুযোগ করে দেয়। সেটা ২০১৮-১৯ মরশুমে। গুজরাটের বিরুদ্ধে অভিষেকে পাঁচ উইকেট-সহ ওই মরশুমে তিনি ২৯ উইকেট দখল করেন। এরপর ফের এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে যান। সেখানে স্ট্রেস ফ্যাক্টর ইনজুরি আবার তাঁকে মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য করে। ছন্দ কিছুটা হারিয়ে পরের মরশুমে রঞ্জিতে তিনি ৬টি ম্যাচে ১২ উইকেট পান। তবুও ফাইনালে দলে ছিলেন, একটি উইকেট পান। সৌরাষ্ট্রের বাকি সতীর্থদের মতো প্রথমবার রঞ্জি জয়ের স্বাদও পান। গত আইপিএলে আরসিবি-র নেট বোলার সাকারিয়া সৈয়দ মুস্তাক আলি টি ২০-তে ৫ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে নজরে পড়েন। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ও রাজস্থান রয়্যালসে ট্রায়াল দেন। শেষে ১.২ কোটিতে তাঁকে দলে নেয় রাজস্থান রয়্যালস।

ছবি- বিসিসিআই/আইপিএল

পরিবারে অঘটন

যে নিলাম চেতনকে কোটিপতি বানিয়ে দিল তার দিন দুই আগেই তাঁর ভাই আত্মহত্যা করেন। চেতন তখন ইন্দোরে সৈয়দ মুস্তাক আলি টি ২০ খেলতে ব্যস্ত। সে কারণে তাঁকে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। সকলকে বারণ করা হয়েছিল তাঁর পরিবারের তরফ থেকে। ১০ দিন পর তাঁকে জানানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই যেভাবে ভেঙে পড়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন তাতে ভাইয়ের মৃত্য়ুর সঙ্গে সঙ্গেই খবর পেলে হয়তো সৈয়দ মুস্তাক আলিতে খেলাই হতো না। চেতনের বাবা এখন অসুস্থ। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারার আক্ষেপও আর নেই। বরং ছেলের স্বপ্নের আইপিএল অভিষেকের পর তাঁর উপার্জনের টাকায় রাজকোটে একটি বাড়ি করার পরিকল্পনা করছে সাকারিয়া পরিবার।

ছবি- বিসিসিআই/আইপিএল