সুমন ভট্টাচার্য: নেতাইতে গুলি না চললে ২০১১-র নির্বাচনে কী হতো? সিপিএমের অনেক নেতা আড়ালে আবডালে স্বীকার করেন নেতাইয়ে গ্রামাবাসীদের উপর গুলির ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে বামেদের কফিনে শেষ পেড়েক পুঁতে দিয়েছিল।
শনিবার উত্তরবঙ্গের শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজনের মৃত্যু আবার ২০২১-র নির্বাচনে ‘নেতাই মুহূর্ত’ কিনা, সেটা হয়তো ২ মে জানা যাবে। কিন্তু বাংলার রাজনীতিতে এবং সমাজেও গুলি চালনার এত সাংঘাতিক প্রভাব আছে, সেটা হয়তো বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও অনুধাবন করতে পারছেন না। একপয়সার ট্রাম ভাড়ার বৃদ্ধির প্রতিবাদে যে আন্দোলন, তাতে পুলিশের গুলি বামেদেরকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে চলে এসেছিল। নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চের গুলি আবার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতার প্রেক্ষাপট থেকে বামেদের বিদায়কে নিশ্চিত করে দিয়েছিল। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন, সেখান থেকে নন্দীগ্রামে গুলি এবং তারপরে নেতাইতে গ্রামবাসীদের উপরে সিপিএম বাহিনীর গুলি তৃণমূলের জয়কে সহজ করেছিল।
২০২১-এ কোচবিহারের শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজন গ্রামবাসীর মৃত্যু আবার সেই সব স্মৃতিকে উসকে দিয়েছে। এবং এবারের নির্বাচনে যেহেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিশানা করছেন, তাই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে কেন শীতলকুচিতে এই ধরনের ঘটনা ঘটলো। কোচবিহারের পুলিশসুপার দেবাশিস ধর এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর তরফে যতই ‘আত্মরক্ষার তথ্য’ দেওয়া হোক, অরুণাভ ঘোষের মতো কট্টর মমতা বিরোধী আইনজীবীরাও প্রশ্ন তুলছেন, কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে পুলিশ লাঠি অথবা কাদানে গ্যাস না ছুড়ে একেবারে সরাসরি গ্রামবাসীদের শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালালো?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই রাজনৈতিক আক্রমণ অন্য গুরুত্ব পাচ্ছে বিজেপি নেতাদের ক্রমাগত বিভিন্ন মন্তব্যে। এর আগে বিজেপির রাজ্যসভাপতি দিলীপ ঘোষ বা দলের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বারে বারে বলেছেন ‘পুলিশ গুলি চালিয়ে মারবে’। আমাদের মনে রাখতে হবে সিএএ বা এনআরসি নিয়ে যখন রাজ্যে তুমুল বিক্ষোভ হচ্ছিল, তখন দিলীপ ঘোষের এই মন্তব্য নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। এমনকি এবারের নির্বাচনে বিজেপির দুই তারকা প্রার্থী, কেন্দ্রীয়মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তও দিলীপ ঘোষের এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। গেরুয়া শিবিরের অন্যদুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার সোশ্যাল মিডিয়াতেই বক্তব্য ছিল যে বিজেপির রাজ্য সভাপতির মন্তব্য অসংবেদনশীল।
এবারের নির্বাচনে যেহেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারে বারে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী বিজেপির নির্দেশে উঠছে এবং বসছে বলে অভিযোগ করছেন, সেহেতু কোচবিহারের এই গুলি চালনার ঘটনা মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলার মানুষ মনে করতেই পারে যে কেন্দ্রের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসলে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং অমিত শাহ তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় থেকেই অভিযোগ উঠেছে যে গুজরাট পুলিশ ভীষণ ভাবেই ট্রিগার হ্যাপি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে যে ভাবে রক্ত ঝরলো এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিষয়টিকে ব্যবহার করে যে ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে গোটা রাজনৈতিক আক্রমণটা ঘুরিয়ে দিলেন, তাতে গেরুয়া শিবির যথেষ্টই অস্বস্তিতে পড়তে পারে।
মজার বিষয় হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই ট্রিগার হ্যাপি মনোভাবকে বামেরাই বা কি করে সমর্থন করবে? তাহলে বামেদের এতদিন ধরে তৈরি করা ভাবমূর্তি প্রচণ্ড ভাবেই ধাক্কা খাবে। নকশালপন্থীরা, যাঁরা এমনিতেই গেরুয়া শিবিরের দিকে খড়্গহস্ত এবং বিজেপির হাতে রাষ্ট্রশক্তি যাওয়ার চরম বিরোধী, তাঁরা ইতিমধ্যেই এই বিষয়টিকে নিয়ে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হচ্ছে, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর অনেক গুণ, ভোট করাতে ভোটার খুন’। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক দিক থেকে সংবেদনশীল রাজ্যে, যেখানে নকশালপন্থী এবং সমাজকর্মীরা এমনিতেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচারাভিযান চালাচ্ছিলেন, সেখানে শীতলকুচির ঘটনা তাঁদের গেরুয়া শিবির বিরোধী প্রচারকে আরও তীক্ষ্ণ এবং সংহত করবে।
সমস্যা হচ্ছে বিজেপি যে সব নেতারা টেলিভিশন চ্যানেলে গিয়ে গুলি চালনাকে সমর্থন করছেন, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন এমনকি কাশ্মীরেও যখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে, তখন বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছে, এবং আদালতের নির্দেশে তদন্ত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত অফিসারদের শাস্তি হয়েছে। তাহলে কাশ্মীর যেখানে ‘আসস্পা’ আছে, সেখানে যদি ভুল কাজের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ভোট সামলাতে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই গুলি চালনাকে আদালতে কীভাবে বিজেপি নেতারা ‘রক্ষাকবচ’ দেবেন?
শীতলকুচি তাই ২০২১-এর নির্বাচনের নির্ণয়ক মুহূর্ত ছিল কি না, তা জানতে হয়তো আমাদের আরও তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্রথমেই সবার স্বীকার করে নেওয়া উচিত দল-মত নির্বিশেষে সকলের যে, কোনও গণতন্ত্রে প্রাণহানীর ঘটনা দুঃখজনক এবং লজ্জার বিষয়। সেই গণতন্ত্রের এই লজ্জাকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.