বিখ্যাত ইংরেজি প্রবাদ, শয়তানকেও তাঁর প্রাপ্য অংশিদারিত্ব দিতে হয়। ২০২১-য়ের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি। আর সেই বিজেপির প্রধান কান্ডারী নরেন্দ্র মোদি এবং তৎ সেনাপতি অমিত শাহ। মূল লড়াইটা নরেন্দ্র মোদি বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছে, এমনটা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের কাছে নরেন্দ্র মোদি ‘ডেভিল’। কিন্তু সেই ডেভিল কে তাঁর প্রাপ্য অংশিদারিত্ব দিতে হবে।
তার কারণ এবারের লড়াইটা এমন একটা সাংঘাতিক অভূতপূর্ব জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার প্রধান কারণ কিন্তু নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। বিজেপির সামগ্রিক রণকৌশলের পিছনে একম্মদিতীয়ম ব্যক্তিত্ব কিন্তু নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি কিভাবে প্রতিটি মুহূর্তে নির্বাচনের জয়লাভের জন্য যাবতীয় কর্তব্য পালন করে চলেন, তাঁর মানসিকতা , তাঁর কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় সেগুলি কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত বিজেপি বিরোধী শিবির বুঝবে, জানবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপির রণকৌশল কে তাঁরা ডিকোডকরতে পারবে না।
নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন জেতার অনেক আগে থেকে দিল্লি দখলের রাজনৈতিক কৌশল নিতে শুরু করেন কাউকে কিছু না জানিয়ে এবং তারপর কতিপয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে একটা স্ট্যাটিজি তৈরি করেন ঠান্ডামাথায়। তারপর তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু উপদেষ্টার কথা শোনেন এবং একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ তৈরি করেন।
তিনি সেই কর্মযজ্ঞের ঋত্বিক, আর তাঁর সেনাপতি অমিত শাহ সেদিনও তাঁর সঙ্গে ছিলেন , আজও আছেন একই ভাবে। অমিত শাহর নিজের জীবন কথা থেকে জানা যায়, যখন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তজালেজড়িয়ে পড়েছেন, নানান রকমের বাধা-বিপত্তির মধ্যে তিনি দিন কাটিয়েছেন, এমনকি তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে, সেই দিন থেকে তিনিও ভাবতে শুরু করেছিলেন যে কিভাবে নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে দিল্লিদখল করা সম্ভব হয় এবং তিল তিল করে সেই রণকৌশল নিয়েছিলেন।
এই বার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদি, মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়ের দশ বছরের সরকারের কোথায় কোথায় দুর্বলতা, বিজেপির কোথায় কোথায় দুর্বলতা এবং তার প্রেক্ষিতে কিভাবে এগোতেহবে সেটা প্রথম ঠিক করেন। এক এক করে নরেন্দ্র মোদির সেই রণকৌশল আমরা ডিকোড করার চেষ্টা করবো।
পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ এমনকি বহু সাংবাদিক জানেন না নরেন্দ্র মোদি কিভাবে কাজ করেন। এটা আমি জানি, তার কারণ ঘটনাচক্রে ১৯৮৭ সাল আমি থেকে বিজেপি নামক দলটা কভারকরছি এবং বাজপেয়ী, আর্টবানী এবং তারপর মোদি, অমিত শাহকে খুব কাছ থেকে পেশাদারি কারণে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি নিশ্চয়ই নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি, যে আমি একই সঙ্গে বুদ্ধদেবভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই মুখ্যমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি, যে যে সংবাদপত্রে কাজ করেছি, তার সৌজন্যেই।
মোদি প্রতিনিয়ত বাংলা নিয়ে ভাবনা -চিন্তা করছেন এবং এখনও তিনি কিন্তু তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভোট যুদ্ধের সময়ও তিনি নিরন্তর আগে যেটা করেছেন তাতে যদি কোনো ভুল থাকে , সেটাকে শুধরেনিচ্ছেন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে জেতার পর তিনি কিন্তু রেসকোর্স রোডের প্রধানমন্ত্রীর নিবাসে প্রবেশ করার পর ভোট যুদ্ধের কথা ভুলে যাননি। এটা ঠিক তিনি একটা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গোটা দেশের সমস্ত বিধানসভা নির্বাচন এবং অন্যান্য পুরনির্বাচন একই সঙ্গে একটা ভোটের মাধ্যমে সেরে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছেন, যেটা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
কিন্তু যতদিন না সেটা হচ্ছে, তিনি কিন্তু নির্বাচনে জেতার জন্য প্রত্যেকদিন কোথায় কোথায় কী করা উচিত ,সেটাও কিন্তু তাঁর মাথায় রয়েছে। সুতরাং দেশ গঠন , প্রশাসন চালনা, প্রশাসনের সংস্কার, আর্থিক সংকট মোচনের দাওয়াই, বিদেশ নীতিতে নানানসমস্যার সমাধানের চেষ্টা এসব তো তাঁকে করতেই হয়। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ভাবেন যে, এবার উড়িষ্যার বিধানসভা নির্বাচনে কী হতে পারে, সেখানে কী করা উচিত? এবার অসমের নির্বাচনে কি হতে পারে, কি করা উচিত? যেমন এখন তাঁর মাথার মধ্যে সবথেকে বেশি পরিসর নিয়ে রেখেছে ‘মিশন বেঙ্গল’।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশ বছরের শাসনের পর গোটা রাজ্যে একটা ‘ anti-incumbency’ বাংলায় যাকে বলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, তাঁর মুড যে তৈরি হয়েছে এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটি প্রকৃতির সূত্র। সিপিএম- এর দশ বছরের শাসনের পরও সিপিএম – এর ক্ষেত্রেও এই anti- incumbency হয়েছে। ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদীরশাসনের দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর সেই anti- incumbency হতে বাধ্য। এই anti- incumbency মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানান ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন এবং সেখানেও নানান রকমের রণকৌশল আছে, সে কথা অতীতেও আলোচনা করেছি, আবার আলোচনা করবো এবং সেখানে প্রশান্ত কিশোরের(pk) বিভিন্ন দাওয়াই যে সু- নিপুণ ভাবে কাজ করেছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মোদি বিবিধ কর্মসূচির মধ্যে প্রধান যেটা গুরুত্ব দিয়েছে, সেগুলি কি কি?
১- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিদি বলে তিনি কিছুটা হাস্যরস সৃষ্টি করে আক্রমণ করছেন। সেখানে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অন্তত কোথাও কোনো তীব্র কটূতা দেখা যাচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম তিনি দিদি, দিদি করে উচ্চারণ করলেও মূল আক্রমণটা কিন্তু মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ , জেলাওয়ারীলুম্পেন বাহিনীর দাপট এগুলোকেই তিনি ইস্যু করেছেন।
২- বিজেপি নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা হলো যে, মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়েরও কিন্তু গোটা রাজ্যে একটা প্যান বেঙ্গল একটা জনপ্রিয়তা আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনি সিপিএম কে অপসারিত করে সফল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, ভোটার, আদিবাসী ভোটার , হরিজন ভোটার, নিম্নবর্গের ভোটার, তপসিলি ভোটার দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা মমতার বিশ্বস্ত ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মমতার এই জনপ্রিয়তা কে সরাসরি আক্রমণ না করে, পশ্চিমবাংলার যে অবক্ষয় ,উন্নয়নের দিশাহীনতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক সংকট এগুলি কিন্তু তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রী বেশি সচেষ্ট হয়েছে।
৩- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ্যায়কে সামগ্রিক ভাবে বিজেপি আক্রমণের প্রধান টার্গেট করেছে। কিন্তু প্রথম দিকে যেভাবে সেটাকে ব্যক্তিগত ভাবে অভিষেকের বিরুদ্ধে টার্গেট করা হয়েছে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, তাঁর বাড়ি পৌঁছে গেছে এবং সেখানে কিন্তু মমতা যেভাবে তার পাল্টা মোকাবিলা করেছেন, মমতা নিজেও আরও শক্তিশালী ভাবে অভিষেকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব না রেখে, তাতে কিন্তু বিজেপিআবার তার রণকৌশল কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছেন।এবং সরাসরি অভিষেককে আক্রমণ না করে এখন ‘ভাইপো’ নামে সম্বোধন করলেও মূলত তৃণমূলের সিন্ডিকেট রাজ এবং দুর্নীতিকেই বেশি করে আক্রমণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ এককথায় বলা যায় অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও তদন্তর যে কার্যকলাপ, সে ব্যাপারেও কিন্তু খুব বেশি প্রকাশ্য অপারেশনাল কাজকর্ম কিন্তু ভোটের সময় দেখা যাচ্ছে না। কারণ মোদির মনে হয়েছে বেশি করলে সেটা উল্টে হিতে বিপরীত ও হতে পারে।
৪- এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ মোদির নির্বাচনের জয়লাভের একটা চেষ্টার ল্যাবরেটরিতে পরিণত হয়েছে। অমিত শাহ চেয়েছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯- সের স্টাইলে যদি হিন্দুত্বের ইস্যু কে সামনে রেখে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ করে দেওয়া সম্ভব হয়। ২০১৯- শে সেটা হয়েছিল আমি নিজের চোখে দেখেছি ধর্মতলায় বাঙালী জয় শ্রী রাম স্লোগানদিচ্ছে অমিত শাহ রোড শো তে। এবং সেটা দেখে আমি খুব বিস্মিত হয়ে ছিলাম, বিপুল সময় বাঙালি কিভাবে এই হিন্দুত্বের স্লোগানে অমিত শাহর আহ্ববানে সাড়া দিয়েছিল।
৫- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯-সের পরিস্থিতিটা যখন বুঝতে পেরেছেন, এবং২০২২ কে যদি আমরা ২০১৯- সের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করি, তবে সেটা হয়তো আপলের সঙ্গে কমলালেবুর তুলনা হয়ে যাবে। সেই কারণে নরেন্দ্র মোদি ও কিন্তু তাঁর বক্তৃতায় এবং বিজেপির রাণকৌশলেহিন্দুমুসলিম ধর্মীয় মেরুকরণকে কাজে লাগলেও সেটা কিন্তু উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের স্টাইলে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে করছেন না। সেটা করছেন যাকে ইংরেজিতে বলে’উইথ সার্টেলটি’।
বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন যে, বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ তাঁরা সিপিএম কে সরাতে মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থনকে সমর্থন করেছিলেন, যদিও এই ভদ্রলোক অভিজাত সম্প্রদায় একান্ত নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্ক ছিল তা নয়, তাঁরা মমতাকে নিম্নবর্গের মানুষ বলে মনে করেছে এবং তাঁরা নিজেরা শ্রেণী সচেতন ছিলেন, যে তাঁরা কিন্তু নিম্নবর্গের নয়। এবার সেই অভিজাত শহুরে কলকাতা সমাজ, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশ বছরের আসনের পর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাতে চাইছেন এবং তার জন্য বিজেপিকে সমর্থন করতে পারেন।
যদিও তাঁরা মতাদর্শ গত ভাবে বিজেপি পন্থী নন, এটা নরেন্দ্র মোদি জানেন এবং জেনেও কিন্তু বিজেপিএবং Rss সম্মিলিত ভাবে আজ নয় কয়েক বছর ধরে বাংলার যে public intellectual বা নাগরিক সমাজ সেটার মন জয় করার জন্য ব্যপক ভাবে চেষ্টা করেছেন। এবং সেই চেষ্টায় মোহন ভাগবতের সংবাদপত্রের মালিক কলকাতা সংবাদপত্রের বাঙালি মালিকদের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে, চলচ্চিত্র জগত, সংগীত জগত, সাংস্কৃতিক জগতের ও রথী মহারথীদের কাছে পৌঁছনো, এই সবটাই কিন্তু সেই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত।সেই কারণেই সৌরভ থেকে মিঠুনকে নিয়ে আসার চেষ্টা, সেই কারণেই অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের, প্রসেনজিতের সঙ্গে দেখা করে অমিত শাহ-য়ের জীবনী গ্রন্থ তাঁকে উপহার দিয়ে, সেটার ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় করা। এসবই কিন্তু সেই রণকৌশলের অঙ্গ।
৬- নরেন্দ্র মোদি নিজে কিন্তু প্রত্যেকটা সভার মধ্যে দিয়ে যেটা তুলে ধরতে চাইছেন , সেটা হচ্ছে, তাঁর স্লোগান হচ্ছে ‘বিকাশ, বিকাশ এবং বিকাশ’। অর্থাৎ রেনেসাঁস শহর কলকাতা, বাঙালি তাঁর যে গৌরব, সেই গৌরব গাঁথার অপসৃয়মান ধংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ। এবং পশ্চিমবঙ্গকে যদি উঠে দাঁড়াতে হয় তাহলে সেটা নরেন্দ্র মোদি করতে পারে। নরেন্দ্র মোদিরগোটা দেশের জাতীয় স্তরে যে জনপ্রিয়তা আছে, পশ্চিমবঙ্গে সেই জনপ্রিয়তা কিন্তু একটা বড়ো অংশের মানুষের মধ্যে আছে। আমি নিজে বিভিন্ন জেলা গুলোতে ঘুরে দেখছি, একটা নবীন প্রজন্মের যুবক, তাঁরা কিন্তু ভাবতে শুরু করেছে যে বোধহয় নরেন্দ্র মোদি এলে চাকরি-বাকরিপাবো, বোধহয় আমাদের কাজকর্ম হবে। শুধুমাত্র ক্লাব গুলোতে বসে ক্যারাম খেলার দিন শেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু এটা হয়তো একটা মিথ্যে এবং সেই মিথ, সেই আলেখ্যটা সুষ্ঠভাবে ভাবে রচনা করতে কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি করতে অনেকটা সফল হয়েছে। সোশ্যালমিডিয়া এবং বিভিন্ন হোয়াটস আপ গ্রুপ, ট্যুইটার একাউন্ট, ইনস্টাগ্রামবিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে যেটা তৈরি করা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে একটা ইন্টারনেট ল্যান্ডস্কেপ। আমি বলি ইন্টারনেট সেনা-স্বেচ্ছাসেবী। তাঁরা এসবের মাধ্যমে একটা মিডিয়া ইকো- সিস্টেম তৈরি করছে বিজেপি। এবং যার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে তাঁরা এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সফলতার সঙ্গে সিপিএম কে তাড়িয়েছেন কিন্তু দশ বছর পর রাজ্যের কোনো উন্নতি হয়নি, রাজ্যে বরং তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীর দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এবারে নরেন্দ্র মোদি এলে পশ্চিমবঙ্গের শান্তি ফিরবে, হিংসা থাকবে না এবং পশ্চিমবঙ্গে একটা কর্মসংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
বিজেপির এই হিন্দুত্ব রাজনীতির মোকাবিলায় মমতাও কিন্তু একটা সাংঘাতিক চাল চেলেছেন এবার। সেটা হচ্ছে বাঙালির আত্ম পরিচিতির বিষয়টি। সেখানে এবারে লড়াইটাকে মমতা ও কিন্তু বাঙালিরপরিচয় সত্তা উত্থাপন করে যে আউট সাইডার শব্দটির প্রচলন করেছেন , সেটা কিন্তু প্রথম দিকে বাঙালি, অবাঙালি একটা বিভাজনের রাজনীতি বলে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মমতা ও সেটাকে সংশোধিত করে মূল লড়াইটাকে দিল্লি বনাম বাংলায় পরিণত করেছেন। যারা বহিরাগত, যারা পাঠান- মোগলের মতো পশ্চিমবঙ্গকে লুন্ঠন করতে, পশ্চিমবঙ্গকে সাংস্কৃতিক ভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে আগ্রাসনের মনোভাবনিয়ে আসছেন, এই ধারণা তৈরি করেছেন এবং সেই কারণে রবীন্দ্রনাথের স্টাইলে প্রলম্বিত দাড়ি নিয়ে নরেন্দ্র মোদি তিনি বাংলায় কথা বলছেন এবং শুনছিলাম প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের লোকজনও বলছেন, যখন দু ঘন্টা ধরে তিনি কলকাতায় আসেন তখন কিন্তু বাংলায় কি কি কথা বলবেন এবং শুধু তাই নয় কেরালায় গিয়ে তিনি মারোআড়ি ভাষায় কথা বলছেন। কিন্তু বাংলায় প্রধানমন্ত্রী যে কথা গুলো বলছেন তার উচ্চারণের যে ত্রুটি সেগুলো পর্যন্ত ক্রমশ সংশোধনের চেষ্টা করছেন।
অর্থাৎ প্রথমে যখন শুরু করেছিলেন তখন তার বাংলা এক সেন্টার, এখন বাংলার এক সেন্টারের মধ্যে তফাৎ হয়েছে। সুতরাং একটা নিরন্তর পরিশ্রম এবং একটা সংশোধনের চেষ্টা এবং দূর পর্যন্ত দেখার ক্ষমতা কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আছে। সেই কারণে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে যেমন একটা সাম্প্রদায়িকতার জন্য বিরাট ভাবে মানুষের মধ্যে একটা বিরোধিতা আছে আবার তাঁর যোগ্যতা নিয়েও কিন্তু বহু মানুষ সন্দিহান নয়। তাঁরা মনে করেন যে নরেন্দ্র মোদিকিছুতে হাত দিলে সেটা করেই ছাড়েন। তারফলে এই লড়াই টা কিন্তু এই বারে একটা’ শঠে শাঠ্যাং’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কে জিতবে বা কে হারবে সে কথা আমি বারবার বলি যে, সে কথা ঘোষণা করা আমার কাজ নয়। কিন্তু দুপক্ষের দুটো শিবিরেই যে একটা তৎপরতা এবং দুটো শিবিরেরই রণকৌশল বিশ্লেষণ করা হলে সেখানে কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির যে রণকৌশলের যে ব্যাপ্তি সেটাও কিন্তু বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।
আজ এই যে প্রায় এক ডজন মন্ত্রী এখানে আসছেন, ডবল ইঞ্জিনের কথা বলছেন এমনকি বহু সাংসদ, বিভিন্ন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন এবং তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছেন। বিহারের একজন রাজ্য সভার সদস্য তিনি এসেছেন , শুধুমাত্র হাওড়াতে গিয়ে বিহারী মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে। তাঁকে বলা হয়েছে তুমি শুধুমাত হাওড়াতে গিয়ে বিহারীদের সঙ্গে লিটটি খাও।আর খৈনি খাও আর দেশওয়ালি ভাইদের শোনে গল্প করো, বোঝাও তাদের কাছে গিয়ে।
এই যে একটা সাংঘাতিক প্রচেষ্টা, তারমধ্যে ঝগড়াঝাটি বিজেপিরমধ্যেও আছে, তা সত্ত্বেও বিজেপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই রণকৌশল, সেখানে কিন্তু প্রচারের ক্ষেত্রে তৃণমূল পিছিয়ে আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরসবথেকে বড়ো যেটা শক্তি, সেটা হচ্ছে তাঁর এতো অঙ্ক কষে রণকৌশলের চেয়েও , তাঁর একটা স্বতঃস্ফূর্ত আবেদন, আবেগ মথিত আবেদন বাংলার কন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার পরিচয় সত্তাকে রাখতে চাইছেন। দিল্লির বঞ্চনার বিরুদ্ধে, বিমাতৃ সুলভ মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়ে আমাদেরকে বাঁচাতে চাইছেন,এই প্রচারটা সুস্পষ্ট।
অতএব সেই বাবুই পাখির কুঁড়ে ঘরটি খাসা বলার কাহিনী অর্থাৎ হতে পারে আমার অনেক আর্থিক দৌর্বল্য আছে, হতে পারে আমি অনেক কিছু আমি কিছু দিতে পারিনা , তবু সেটা আমার নিজের হাতে বানানো আমার কুঁড়েঘর, সেটাকে রক্ষা করতে হবে, এটা হচ্ছে মমতাবন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দর্শন। এখন এটাই দেখার যে কে যেতে, আর কে হারে এই টান টান লড়াইয়ে।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.