জয়ন্ত ঘোষাল: এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ফলাফল কী হবে সেকথা ভোটের আগে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, আমরা সাংবাদিকরা আমরা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে পারি। আমরা বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নির্বাচনকে দেখতে পারি। কিন্তু ভোটের ভবিষ্যতবাণী করাটা সাংবাদিকের কাজ নয়। আমি জ‍্যোতিষী নই। যারা জ‍্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করেন। তারা জ‍্যোতিষীর কথা শোনেন। আমি সেফোলজিস্টও নই। বৈজ্ঞানিকভাবে ভোটারদের আচরণ সমীক্ষা করে, তাদের বক্তব্য নিয়ে একটা আগাম ভবিষ্যৎবাণী করা। সেটাও আমার কাজ নয়। কিন্তু এবারের ভোটের যেটা সবথেকে বড় রাজনৈতিক ফেনোমেনা। সেটা হল বিজেপির ভূমিকা। বিজেপির মূখিয়া। এদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই এবারের বিধানসভা নির্বাচনের সবচেয়ে বড় কারিগর।

সাংবাদিক হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করা। তাঁর রণকৌশল বিশ্লেষণ করা। আমার মনে হয় সেটার একটা প্রয়োজনীয়তা পাঠকদের জন্য আছে। আমি বহু বছর ধরে নরেন্দ্র মোদীকে ব‍্যক্তিগত ভাবে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। শুধু সেই কারণে নয়। তাঁর রাজনীতিকেও আমি আমার বিশ্লেষণ এবং গবেষণার উপজীব‍্য করেছি। আনন্দবাজার পত্রিকায় থাকার সময়ও বারংবার লিখেছি, যে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহ কীভাবে ইলেকশন মেশিন হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবারের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের সবথেকে বড় নেপথ্য কারিগর। তাঁকে সবসময় দেখা যেতো না। মনে হত অমিত শাহই সবকিছু করছেন। কিন্তু আসলে নরেন্দ্র মোদীই প্রধান চরিত্র। তাঁর অঙ্গুলি হেলনেই অমিত শাহ চলেন। অমিত শাহের রণকৌশল। সেটা নরেন্দ্র মোদীর রণকৌশল। অমিত শাহ সেটা যথাযথ সঠিক শিষ্য হিসেবে প্রয়োগ করেন।

নরেন্দ্র মোদীর ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা এবার সেগুলো পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে কাজ করেছে। সেটা আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। প্রথমত, প্রতিপক্ষ যে পথে চলে। নরেন্দ্র মোদী সবসময় সে পথে চলেন না। প্রথমেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম, যে বিজেপি ধর্মের মেরুকরণের সাহায্য নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোট হবে। অনেকে মনে করেছিলেন, অমিত শাহ সেটা সহজ ভাবে সুকৌশলে করতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদী নিজের বক্তৃতায় কখনোই হিন্দুত্বকে স্থূল ভাবে প্রজেক্ট করে ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করছেন না। আসলে আমি অতীতের নির্বাচনেও দেখেছি। অমিত শাহ যেটা করেন। নরেন্দ্র মোদী সেটা করেন না। নরেন্দ্র মোদী উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে, এমনকি উত্তরপ্রদেশেও বারবার একটা কথা বলে চলেছেন, বিকাশ। বিকাশ। বিকাশ। ২০১৪ সালেও তিনি একদিকে যেরকম ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ হয়েছেন। অন‍্যদিকে তিনি নিজেকে ‘বিকাশ পুরুষ’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।

নরেন্দ্র মোদী বাংলা সম্পর্কে তাঁর একটা সুস্পষ্ট অভিমত আছে, যে বাংলা কিন্তু অন্য রাজ‍্যগুলোর মতো নয়। এই রাজ‍্যে যে শুধু শিক্ষিতের হার বেশি তাই নয়। সাংস্কৃতিক গৌরব এই রেনেসাঁ শহরে অনেক বেশি। এইরকম
একটা রাজ‍্যে খুব স্থূলভাবে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে ২০১৯ এ ভোটে ১৮টা আসন বিজেপি পেয়েছে। কিন্তু তার প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে সেই কারণে বিজেপি তার রণকৌশল বদলেছে। তার জন্য প্রধান কৃতিত্ব নরেন্দ্র মোদীর। দ্বিতীয়ত নরেন্দ্র মোদী দিনক্ষণ টাইমিং, কখন কী বলা। এগুলো অত্যন্ত সচেতন এবং সুপরিকল্পিত ভাবে করেন। ভোট যেদিন হচ্ছে সেইদিন বাংলাদেশে যাওয়া। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আগে থাকতে সমন্বয় সাধন করে, সেইদিন মতুয়ার প্রতিষ্ঠাতার মন্দির দেখতে যাওয়া। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশেও গিয়ে তিনি অনেক বাংলায় কথা বলেছেন। তাতে একদিকে যেমন বাংলাদেশে তাঁর প্রভাব পড়েছে। আবার অন‍্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের ভোটেও তাঁর প্রভাব পড়েছে। চতুর্থত নরেন্দ্র মোদী প্রচণ্ড হোমওয়ার্ক করেন। পশ্চিমবঙ্গে বিমানে আসতে দুঘন্টা লাগে। এই দুঘন্টা সময় ধরে বাংলায় তাঁর বক্তৃতা গুলো রিহার্সাল দেন। তিনি উচ্চারণ পর্যন্ত ঠিক করার চেষ্টা করেন। উচ্চারণটা ভাষার থেকেও কঠিন হয়। যেটাকে আমরা Accent বলি। অর্থাৎ আমরা বাঙালিরা যে হিন্দিতে কথা বলি। সেটা অনেকটা ফেলুদার লালমোহন গাঙ্গুলির মতো। সেই উচ্চারণটা তো হিন্দি ভাষীরও বাংলা উচ্চারণের ক্ষেত্রে একই সমস্যাটা থাকে। আমি তো দেখেছি, বিমানে এয়ারহোস্টেজরা বা পাইলটরা ‘কলকাতা’- শব্দটাও যারা বাঙালি নয় তারা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না। বাংলায় উচ্চারণটাতে নিজেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত করার চেষ্টাটা আছে। সেটা কিন্তু বোঝা যায়। কেননা আপনি যদি দুমাস আগের নরেন্দ্র মোদীর বাংলা শোনেন। আর তাঁর আজকে বলা বাংলার মধ্যে কিন্তু তফাৎ আছে। ইংরেজিতে কথা আছে ‘ডেভিলকেও তার শেয়ার দিতে হয়’। এক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীর মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, তাঁর এই কৌশল। তাঁর এই কৃতিত্বের কথা তৃণমূল নেতাদেরও স্বীকার করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সেটা স্বীকার করেন না তা নয়।

এরপর সবথেকে বড় বিষয় হল, নরেন্দ্র মোদী প্রচণ্ড পরিশ্রমী। ভোটে জেতার জন্য যে পরিশ্রমটা তিনি করেন। এই মুহুর্তে গোটা দেশের অন্য কোনো নেতা করেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। এই পরিশ্রমটা কিন্তু শুধু একবার জিতে যাওয়ার পর। একবার সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভোগ-বিলাসে লিপ্ত হয়ে গেছেন এমন নয়। প্রতিদিন। প্রতিমুহুর্তে। ভোটে জেতার জন্যে প্রতিনিয়ত তিনি সচেতন থাকেন। তাঁর প্রত‍্যেকটা টুইট। তাঁর প্রত‍্যেকটা সোশ্যাল মিডিয়ার কাজকর্ম। আমলাদের সঙ্গে তাঁর প্রত‍্যেকটা বৈঠক। রাজ‍্যগুলোর সঙ্গে বৈঠক। সারাক্ষণ তাঁর পারসেপশন তৈরির রাজনীতি। যেটা ভোটে প্রভাব বিস্তার করবে। তিনি কিন্তু শুধু ২০২৪ নয়। সম্ভবত তারপরের নির্বাচনের জন‍্যেও তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জেতা-হারা পরের কথা। কিন্তু প্রস্তুতির কিন্তু কোনো তুলনা হয় না।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতা বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর জন্য খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। অন‍্য রাজ‍্যে যে মেহনতটা করা হয়েছিল বা করেন। পশ্চিমবঙ্গে তার থেকে অনেক বেশি করেন। সেই কারণে তিনি কুড়িটা জনসভা করছেন। এক ডজন মন্ত্রী এখানে ঘোরাফেরা করছেন। অমিত শাহ এখানে আগামী একমাস ধরে ক‍্যাম্প করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। প্রতিটা ক্ষেত্রে ছত্রধর মাহাতোর গ্ৰেপ্তার থেকে, এসপি, ডিএম বদলি থেকে শুরু করে। প্রতি মুহুর্তে এইরকম ভাবে করে চলেছেন, যা কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ভাবতেই পারবেন না। এইরকম পরিশ্রম করে গোটা দেশে একটা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা। যার কোনো তুলনাই হয় না।

শেষ করব অতীতের একটা ভোটের কথা ভেবে। ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন। নৃপেণ চক্রবর্তী কমিউনিস্ট মুখ‍্যমন্ত্রীর বিদায়। সুধীর মজুমদারের আগমন। সেই সময় সন্তোষমোহন দেব কেন্দ্রীয় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। তাঁকে দেখেছি কীভাবে ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ‍্যের মানচিত্র হাতে রেখে টেবিলের ওপর পেতে সেনা অফিসার দের সঙ্গে বৈঠক করছেন। কোন কোন জায়গায় টিএনভি হত‍্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। বিজয় রাংখেলের নেতৃত্বে বাঙালিদেরকে মারছে। সেসব জায়গায় উপদ্রুত এলাকা হিসেবে ঘোষণা ক‍রতে হবে। উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করে ভোট হচ্ছে। সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। আরেকদিকে ভোটের দিন আগরতলায় এগারো জন বাঙালিকে নিধন করল টিএনভি। তাদের অস্থিকলস সারিসারি ভাবে সাজানো। পাশে ভোটারা ভোট দিচ্ছেন। এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতায় ভোটারদের লাইন। সবাই তখন বাঙালি হত‍্যার জন্য কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটাতে চাইছেন। তারা মনে করছে, কমিউনিস্টরাই একাজ করেছে। তারপর ভোট হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল রাজীব গান্ধী সেই বিজয় রাংখেলের সঙ্গেই শান্তি চুক্তি করে ফেললেন। এইরকম রণকৌশল কি করে নিতে হয়। সেটা ত্রিপুরার সন্তোষমোহন দেবের নেতৃত্বে দেখেছিলাম। তখন ভোটের পর সন্তোষ বাবুকে রাজীব গান্ধী প্রথমে প্রতিরক্ষা ও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী করলেন শুধুমাত্র ত্রিপুরা বিজয়ের জন্য। এই যে রণকৌশল গ্ৰহনের প‍্যাকেজ। এটা কংগ্রেস জমানায় যে নেওয়া হতো না তা নয়। করতো। কিন্তু রাজীব গান্ধী করতেন না। কিছু কিছু নেতার মাধ‍্যমে তিনি সেই জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। আজ কিন্তু ভোটে জেতার যে রণকৌশল, অর্থাৎ যেটাকে কৌটিল‍্য বলেছিলেন, ‘সাম দান দন্ড ভেদ’। সবরকম ভাবে ভোটে জেতা। সেখানে প্রয়োজনে গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে সংখ‍্যাগরিষ্ঠতার নামে একনায়কতন্ত্রে যথেচ্ছাচার ও হতে পারে। গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েও ভোটে জয়লাভ করা যায়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনে জেতার যোগ্যতা। তাঁর একনিষ্ঠতা। তাঁর সঙ্গে এবারের লড়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের সংগ্ৰাম এবং একনিষ্ঠ লড়াই এর। ভোটের ফল কী হবে জানি না। কিন্তু আপাতত এই টানটান উত্তেজনাটা অনেকটা ভারত-পাকিস্তানের ম‍্যাচের মতো।

লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'! 'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.

করোনা পরিস্থিতির জন্য থিয়েটার জগতের অবস্থা কঠিন। আগামীর জন্য পরিকল্পনাটাই বা কী? জানাবেন মাসুম রেজা ও তূর্ণা দাশ।