প্রসেনজিৎ চৌধুরী: কালরাত্রি- তারপর রাত নামল, ঝিকিমিকি তারা ভরা আকাশ চুঁইয়ে কালো বাদুড়ের মতো ডানা মেলে নেমে এলো অন্ধকার। বুড়িগঙ্গা ছাড়িয়ে ভেসে এলো পাক সেনার গুলির শব্দ। আধো ঘুমে, গভীর ঘুমে থাকা মানুষ হচ্ছিল লাশ। বেশ কয়েকজন রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে বলল-‘আয় …’
২৫ মার্চ, ঢাকা, ১৯৭১– পাক সেনা কর্তৃক গণহত্যার ৫০ বছর। মধ্যরাত পেরিয়ে ২৬ মার্চ ঢাকা, ১৯৭১, গণপ্রতিরোধ শুরু বাঙালিদের। সেই লড়াইয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। আর স্বাধীনতার ডাক দিয়ে টানা ন’য় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রাম, ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে মুক্তি অর্জনের পঞ্চাশ বছর।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যে সংঘর্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ, তাতে তিরিশ লক্ষের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মৃতদেহ ঢেকে থাকা জমির আলপথ পেরিয়ে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর আসে চূড়ান্ত বিজয়। ঢাকায় ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনির যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রায় ৯৯ হাজার পাকিস্তানি সেনা।
“আহ্বান, শোন আহ্বান, আসে মাঠ-ঘাট বন পেরিয়ে/ দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে, বন্যার মত বেরিয়ে..”এই মুক্তি লড়াই শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষার অধিকার ছিনিয়ে আনার ১৯৫২ সালে গণবিদ্রোহের পথ ধরে। সেই অধিকার অর্জনের রাজনৈতিক উত্তরণ সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি।
২৬ মার্চ:: ১৯৭১-২০২১:: বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী
“ঘুমাতেছে।
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী…”
(১৯৪৬-৪৭, জীবনানন্দ দাস)
১৯৭১ সালের আধো ঘুমের রাতে শুরু হয়েছিল মারণযজ্ঞ। বন্দি বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না চাওয়ার গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপ যে দেশটাকেই দ্বিখণ্ডিত করে দেবে, তা পাক সরকারের কল্পনারও বাইরে ছিল। সেনা নামিয়ে গণহত্যা শুরুর ঠিক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার বাণী দিয়েছিলেন- ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনিকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনির শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই বার্তা ছড়িয়ে দেয় বিশ্বজুড়ে। পাক সেনার হামলা, গণহত্যা রাত পেরিয়ে আসে ভয়াবহ সকাল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শুরু হয় প্রতিরোধ। আতঙ্কিত বহু মানুষ জীবন রক্ষায় ছুটে চলেছেন ভারত সীমান্তের দিকে। ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর বার্তা রেডিও সম্প্রচার হয়েছে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। পরের দিন ২৭ মার্চ রাতে তৎকালীন পাক সেনাবাহিনির বিদ্রোহী মেজর ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজে এবং পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এই কলুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকেই।
তারপর যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ…মাঠ ঘাট বন প্রান্তর পেরিয়ে তীব্র আন্তর্জাতিক কূটনীতির জাল কেটে ভারতের সাহায্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর প্রতিরোধে চমকে গেল দুনিয়া। পদ্মা-করতোয়া-আত্রাই-মেঘনার দু কুল ছাপিয়ে এলো সেই সব খবর। গণহত্যার একের পর এক নজির ভেঙে চলেছে পাকিস্তান। আর গণপ্রতিরোধের একের পর এক নজির গড়ে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
কী হবে? বিশ্ব আন্দোলিত। অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন। তারপর ? রক্তাক্ত বাংলাদেশ ঘিরে ষড়যন্ত্র, সামরিক অভ্যুত্থানের পর্ব। ১৯৭৫ ও ১৯৮১ সালে পরপর দুই রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে সেনা অভ্যুত্থানে খুনের দেশটি চলে গেল সামরিক শাসনে। এলো আশির দশক। ১৯৮৩-১৯৯০ সাস পর্যন্ত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন ও জাতীয় পার্টির সরকারের পথ বেয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। এর পর কখনও বিএনপি, কখনও আওয়ামী লীগ সরকার গড়েছে। দুই দলের দুই প্রধান নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা কুর্সিতে বসেছেন। দুই নেত্রীর যুযুধান লড়াই দেখেছে বিশ্ব।
সেনা শাসন থেকে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ক্রিকেট দুনিয়ায় উঠে আসা যেমন চমকপ্রদ তেমনি উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত বনাম যুক্তিবাদীদের লজ়াইয়ের কেন্দ্র এই দেশ। পরপর যুক্তিবাদীরা খুন হয়েছেন, একের পর এক মৌলবাদী নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত একাধিক মুহূর্ত পার করেছে দেশটি। সীমান্তরক্ষীদের ক্ষোভ স্বাধীন দেশটিতে গণহত্যার বিরলতম নজির গড়েছে (পিলখানা গণহত্যা বা বিডিআর বিদ্রোহ)
মহাকাশে গিয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবার বেকারত্বের হারও উর্ধমুখী। অর্থনৈতিক গতিতে আলোচিত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্র। ঠিক তেমনই সর্বাধিক শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী দেশটি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ আলোচিত।
দুই প্রতিবেশী ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তে ঘেরা ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী বয়ে চলা ঘেঁটুফুল, রক্তকরবী, শিমুলে মাতামাতি করা দেশটিতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী-তাদের সদম্ভ আওয়াজ ‘জয় বাংলা’
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.