জয়ন্ত ঘোষাল: আমার এক পাঠিকা শ্রীমতি মহুয়া সম্প্রতি আমাকে হোয়াটসআপে সুকুমার রায়ের ছড়ার কয়েকটা লাইন পাঠিয়েছেন —
‘হাঁস ছিলেন সজারু
ব্যাকরণ মানি না
হয়ে গেল হাঁসজারু
কেমনে জানি না।’
মেসেজটা দেওয়ার পর তার তলায় লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাম-কংগ্রেস-সিদ্দিকী জোটের পরিস্থিতি দেখে এই ছড়াটা মনে পড়ল। আসলে ব্যাকরণ না মেনে কংগ্রেসের সঙ্গে ইন্ডিয়ান স্যেকুলার ফ্রন্টের (আই.এস.এফ) আসন রফা হচ্ছে। আর বামেদের সঙ্গে আই.এস.এফ এর জোট হচ্ছে। সেটা কিন্তু আমার মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এই জোটের মধ্যেও একটা ব্যাকরণ আছে। রবিবাসরীয় ব্রিগেডে সুর চড়িয়ে কংগ্ৰেস নেতৃত্বকে বার্তা দিয়েছিলেন আই এস এফ এর পৃষ্ঠপোষক আব্বাস সিদ্দিকী। তিনি কী বললেন ?
বললেন, ‘তোষণ নয়। ভাগিদারী চাইছি।’ ফলে শুরুতেই কংগ্রেসের সঙ্গে স্যেকুলার ফ্রন্টের সমঝোতা ধাক্কাও খেয়েছে। কিন্তু তোষণ নয়। মুসলমান সমাজ ভাগিদারী চাইছে। এই বার্তাতে পশ্চিমবঙ্গের বহু মুসলমান মানুষ উজ্জীবিত হয়েছেন। এক বিদগ্ধা মুসলিম মহিলা পাঠিকা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানিয়েছেন, যে হতে পারে রাজনীতির কূটতা আছে এই জোটে। কিন্তু সিদ্দিকীর এই কথাটা শুনে মনে হল অনেকদিন পর ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে মুসলমান সমাজকে তোষণ করার রাজনৈতিক প্রবণতার বিরুদ্ধাচারণ করা এবং এই ভাগিদারী চাওয়া। এটাও বোধহয় প্রথম শোনা গেল।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে এবার এক ধর্ম সংকট। দাঙ্গা। খুন। বিস্ফোরণ। অগ্নিসংযোগ। এই সব তো এখন ভোটের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতারা যখন সিদ্দিকীর সঙ্গে হাত মেলান। তখন তাতে বিস্মিত হই না। মনে হয় এটা হাঁসজারু নয়। এতে একটা ব্যাকরণ আছে। স্বাধীনতার সময় দ্য গ্ৰেট ক্যালকাটা রায়ট আমরা দেখিনি। কিন্তু ভুলিনিও তো। আর সেই দাঙ্গার আগের দিন ‘৪৬ সালের রক্ত গরম করা বক্তৃতা। সেই বক্তৃতাও তো বঙ্গবাসী ভোলেনি। সেদিন কমিউনিস্টরা ওই দেশভাগের এবং মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের কার্যত প্রকারন্তরে সমর্থনই করে বসেছে।
আমি ‘৮৪ সালে সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। কিন্তু ‘৮৭ সালে দিল্লিতে যাওয়ার পর থেকে, যেদিন থেকে বিজেপি কভার করা শুরু করেছি। সেদিন থেকে বিজেপির কাছে বারবার শুনে এসেছি, তারা এই কমিউনিস্টদের দেশভাগের বিষয়ে তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় সোচ্চার। অটলবিহারী বাজপেয়ী তো এর ওপরে একটি বই লিখেছেন। কমিউনিস্ট বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে তাঁর একটি ছোট পুস্তিকা আছে। অরুণ সৌরি তো পাতার পর পাতা লিখেছেন। এই যে কমিউনিস্টদের সঙ্গে মুসলিম লীগের আঁতাত কেরলে হয়েছিল। ই.এম.এস নামবুদ্দিরিপাদের প্রথম সরকার গঠনের সময়। সেই সময়ও কিন্তু মুসলিম লীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সখ্য নিয়ে ভারত জুড়ে সমালোচনা হয়েছে। আবার কিছুদিন আগেও বামফ্রন্টের কেরলে মুসলিম লীগের সঙ্গে যাওয়া। সম্প্রতি আবার কমিউনিস্ট পার্টি কেরলে বলেছিল, সেটা ছিল তাদের একটা ঐতিহাসিক ভুল। কিন্তু এখন আবার বিধানসভা নির্বাচনের সময় সেই বামপন্থী যুক্তফ্রন্ট আবার মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝোতা করছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা কেন সিদ্দিকীর সঙ্গে হাত মেলালো ? সেই প্রশ্নটা নানান দিক থেকে উঠছে।
আমার শুরু একটা কথাই মনে হচ্ছে, যে এখন কমিউনিস্ট পার্টিটা ওই জুরাসিকের ডাইনোসরের মতো অবলুপ্তপ্রায়। সেই কারণে বাঁচার তাগিদে এখন মার্কসবাদ ভুলে মুসলিম সমাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার ভেসে ওঠার চেষ্টায় আছে। এটা হচ্ছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এতে যতটা না ‘মার্কসবাদ’। তার থেকে ‘সামাজিক ডারউইনবাদ’ বলাটা বোধহয় বেশি উচিত কাজ হবে। এবারে আমরা যদি কমিউনিস্টদের থেকে সরে আসি, কংগ্রেস কীভাবে তার সঙ্গে আবার লেজুরবৃত্তি করল ? অধীর চৌধুরী যতই গর্জন করুন না কেন। শেষপর্যন্ত জোটটাতে তো উনি থাকলেন। আনন্দ শর্মা থেকে শুরু করে কংগ্ৰেসের অনেক নেতাই অসন্তুষ্ট হলে কি হবে। এটাই তো কংগ্রেসের রাজনৈতিক লাইন হয়ে গেল। এরপর যদি রাহুল গান্ধীর বা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কলকাতায় আসেন। ভোট প্রচারে সিদ্দিকীর সঙ্গে জনসভা করেন। তবে তো আরো বিনোদনের শেষ থাকবে না।
এই যে ব্যাকরণহীন ব্যাকরণ। বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটা শৃঙ্খলা আছে। সেটা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু ভোট। সেটাকে ভাঙন ধরানো। তার থেকে কিছুটা করায়ত্ত করা। এটাই হল লক্ষ্য।
আবার ফুরফুরা শরিফের মধ্যেও নির্বাচনের প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক আছে। ১৯৩৯ সালে দাদা হুজুর প্রয়াত হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে। দেশের সর্ব প্রথম নির্বাচন হয়েছে ১৯৫২ সালে। তাঁর রাজনীতি করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তার ভাবনার ছিল বিশ্বমানব। সুদূর আরবের ভূমি থেকেও সম্মানজনক সনদ পেয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন বহু ভাষাবিদ — ডঃ শহিদ্দুল্লাহ, সুফি তাজামমল হোসাইন সিদ্দিকী ও সাই সিদ্দিকী। বসিরহাটের আল্লামা রুহুল আমিনের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা। তাঁরাও কিন্তু রাজনীতিতে জড়াননি। ব্রিটিশ শাসকেরাও পিরজাদাকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেছেন। বাংলার ভাষার কথা বলে তৎকালীন রাজশক্তিকে দিয়েছিলেন মোক্ষম জবাব। তাঁর পাঁচ সুযোগ্য পুত্র বাবার দেখানো পথে হেঁটেছেন। বর্তমানে বয়জ্যোষ্ঠ উত্তরসূরীরা ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। তাহলে দেশে শতাধিক পীরজাদার মধ্যে হাতেগোনা দু-একজন ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন কেন ? এতে পীরসাহেবদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষও কী আব্বাস সিদ্দিকীর এই দলটাকে ভালো চোখে দেখছে ? ফুরফুরা শরিফ কি তার প্রধান কাজ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে ? এ প্রশ্নও উঠেছে।
আবার আরও মজার ব্যাপার। সেদিন কমিউনিস্টদের ব্যাঙ্গ করে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এক অধ্যাপক বললেন, চেগুয়াভারার জায়গায় এখন তো কমিউনিস্টরা ফুরফুরায় এসে পৌঁছেছেন। অস্তিত্ব রক্ষার কি লড়াই । কিন্তু এইসব দেখে শুনে একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, এটাতে লাভ কার হবে ? নেঁপোয় দইটা কে মারবে ? মুসলমান ভোট যদি সত্যি সত্যি ভাগাভাগি হয়। তাহলে কার লাভ ? কেননা বিজেপি আর যাইহোক মুসলমান ভোট পায় না। কয়েকটি জায়গায় মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দেয় বলে যে মাইথলজি চালু হয়েছে। তার পেছনেও আমার মনে হয় অন্যান্য অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। লক্ষৌতে বাজপেয়ী বা গুজরাটে মোদী মুসলিম ভোট পেয়েছেন। এই যে বক্তব্য, সেটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। অনেক সময় ভয়ে। নিরাপত্তার অভাব থেকেও। এই ভোট তারা দেয় বলে মনে করা হয়।
সুতরাং এটাতে সার্বিকভাবে বিজেপিরই লাভ হয়ে যাবে এমন একটা ধারণা কিন্তু জনমানষে তৈরি হয়েছে।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.