সুমন ভট্টাচার্য: রাহুল গান্ধী কি ভারতীয় রাজনীতির নতুন ‘শাহজাদা দারাশুকো’? ঘাতকের ছুরি যাঁর জন্য সবসময় অপেক্ষা করে আছে, কিন্তু যিনি রাজনীতিতে সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কোনও খামতি রাখবেন না? ইতিহাস বলে, ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যা শাহজাদা দারাশুকোকে দিল্লির মসনদে বসতে দেয়নি, কুর্সি মিলেছিল ঔরঙ্গজেবের বরাতে। কিন্তু উদার, শিক্ষিত হিসাবে ইতিহাসের পাতায় শাহজাদা দারাশুকোর নাম বার বার উল্লেখিত হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি করা ভুল হয়েছিল, প্রকাশ্যে একথা বলে দিয়ে রাহুল গান্ধী বোধহয় আর একবার প্রমাণ করলেন তিনিও আসলে শাহজাদা দারাশুকোর গোত্রের রাজনীতিক, যাঁর কাছে ক্ষমতা বা মসনদের চাইতে রাজনীতির শুদ্ধিকরণ অনেক বেশি জরুরি।

ইন্দিরা গান্ধীর জারি করা জরুরি অবস্থা তো শুধু কংগ্রেসের রাজনৈতিক ইতিহাসে কালো দাগ নয়, ভারতবর্ষের গণতন্ত্রেও অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়। শুধু সংবাদ মাধ্যমের কন্ঠরোধ নয়, যে ভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশকেও সেই সময় বাধা দেওয়া হয়েছিল, তা বার বার আমাদের স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে গান্ধী পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের রাজনীতিক রাহুল গান্ধী যেদিন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জরুরি অবস্থার ‘ভুল’কে স্বীকার করে নিলেন, ঠিক তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মার্কিন নজরদারি সংস্থা ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকেও পুরোপুরি ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ আখ্যা দিতে চাইল না। দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং চিনের মতো একটি একদলীয় শাসনের ‘রোল মডেল’ সব সময় আতঙ্কের জুজু দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, মায়ানমারে সু চি-র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে, তখন রাহুল গান্ধীর মন্তব্য এবং মার্কিন ‘ওয়াচডগ’এর তালিকা প্রকাশ আলাদা রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে।

জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ যে সেই সময় স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কোনও সুযোগ ছিল না। এমন কি ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র প্রয়াত সঞ্জয় গান্ধীর কথা মতো গান গাইতে চাননি বলে প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কিশোর কুমারের গান বাজানো অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণী বন্ধ করে দিয়েছিল। অর্থাৎ সেই সময় কেন্দ্রের শাসক দলের বিরাগভাজন হলে, শিল্পীদেরও কতটা রোষানলে পড়তে হতো, তা আমাদের মনে রাখতে হবে। ইতিহাসের কি আশ্চর্য সমাপতন দেখুন, ইন্দিরা গান্ধীর দৌহিত্র যখন তাঁর ঠাকুরমার ভুল হয়েছিল বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন, মার্কিনী নজরদারি সংস্থা যখন ভারতবর্ষের গণতন্ত্র কতটা ‘মুক্ত’, সেই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে, ঠিক তখনই আবার বর্তমানে কেন্দ্রের শাসক দলের যাঁরা সমালোচক, সেই অনুরাগ কাশ্যপ বা তাপসী পান্নুর মতো শিল্পীদের বাড়িতে আয়করের তল্লাশি হচ্ছে। অর্থাৎ আবার প্রশ্ন উঠছে, ১৯৭৫ এর জরুরি অবস্থা জারির প্রায় পয়তাল্লিশ বছর পরে, ভারতীয় গণতন্ত্র কতটা সাবালক এবং ‘মুক্ত’ হিসাবে বিকশিত হতে পেরেছে? ভারতীয় গণতন্ত্র কি বিরোধী কন্ঠস্বরকে স্বীকৃতি দিতে বা সেই আওয়াজকে শুনতে শিখেছে?

বিভিন্ন ধরনের কটাক্ষ, ‘পাপ্পু’ আখ্যা এবং অনেক সময়ই রাজনীতি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া রাহুল গান্ধীকে সমসাময়িক আলোচনায় গুরুত্ব পেতে দেয়নি। এমনকি আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, ডেমোক্রাটদের তারকা নেতা বারাক ওবামা তাঁর আত্মজীবনীতে গান্ধী পরিবারের এই নবতম প্রতিনিধিকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। এই সব কিছুর পরেও সনিয়া গান্ধীর পুত্র ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা অনেকগুলি কারণে। তিনিই গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের আজকের উত্তরসুরী, এটি একটি কারণ হতে পারে, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে তিনি রাজনীতিতে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা বারবার বলেছেন, যা যেকোনও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে। যেমন মার্কিন ধাঁচে তিনিও ‘টাউন হল’ জাতীয় সভার উপর জোর দেন, যেখানে নেতা শুধু বক্তৃতা দেন না, সভায় উপস্থিত নাগরিকরাও নিজেদের মতো করে প্রশ্ন করতে পারেন, মতামত জানাতে পারেন। আবার তিনি আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির পরামর্শ মতো ভারতের অবহেলিত শ্রেণীকে অর্থনৈতিক ভাবে চাঙ্গা করার জন্য সরাসরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার মতো নীতি আনার কথা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবে বলেন।
গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের দায় যেমন রাহুল গান্ধীর এবং সেই ‘ব্যর্থতা’র দায়িত্ব নিয়ে তিনি যেমন কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই এটাও সত্যি তিনি শতাব্দী প্রাচীন দলকে একটা নতুন চেহারা দিতে বারেবারে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধীর জরুরি অবস্থার জন্য ভুল স্বীকার অবশ্যই গান্ধী পরিবারের এবং কংগ্রেসের ‘কলঙ্ক’-এর ভাগ কমাবে ও ভারতীয় গণতন্ত্রকে নতুন ভাবে ভাবতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে এই ২০২১-এ আবার যখন ভারতীয় গণতন্ত্র কতটা সুরক্ষিত, সেই প্রশ্ন উঠছে।

লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'! 'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.

করোনা পরিস্থিতির জন্য থিয়েটার জগতের অবস্থা কঠিন। আগামীর জন্য পরিকল্পনাটাই বা কী? জানাবেন মাসুম রেজা ও তূর্ণা দাশ।