বিজেপির সঙ্গে কলকাতায় সমাবেশ করাটা যদি সিপিএমের গত ৪০ বছরের সবচেয়ে রাজনৈতিক ‘পাপ’ হয়, তাহলে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে ব্রিগেড করে বামপন্থীরা কি নিজেদের সমস্ত চরিত্রই বিসর্জন দিয়ে দিল? ১৯৮৮ থেকে ২০২১-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৩৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে সিপিএম বারেবারে একই ‘ভুল’-এর পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য যেকোনও ধরনের দল বা সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা।
গত শতকের আটের দশকে যেটা ছিল যেকোনও মূল্যে কংগ্রেসকে হারানো, ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গে সেটাই যেকোনও মূল্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করা। বামফ্রন্টের বহু শরিক দলের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করে নেন, ঐতিহাসিক ভাবে বামপন্থীরা দুটি ভুল করেছেন। প্রথমবার, জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে আরএসএস-এর সঙ্গে হাত মেলানো, কারণ তার আগে পর্যন্ত ‘গান্ধীহত্যা’-র দায় নিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে সঙ্ঘ পরিবার ‘অচ্ছ্যুৎ’ ছিল।
দ্বিতীয়তটি, অবশ্যই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা রাজীব গান্ধীর মোকাবিলা করতে গিয়ে বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে তোলা। আটের দশকে ওই জোট রাজনীতির সময়ই আবার সঙ্ঘ পরিবার বিভিন্ন রাজ্যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়ে যায়।
রাজীবকে হঠাতে এবং ভি পি সিংকে প্রধানমন্ত্রী করতে গিয়ে বামপন্থীরা পরোক্ষে বিজেপিকে যে অক্সিজেন যুগিয়েছিলেন, তারই পরিণতিতে লালকৃষ্ণ আঢবাণী গোটা দেশজুড়ে রথযাত্রার সুযোগ পেয়ে যান। এবং রামজন্মভূমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্ববাদী শক্তি হিসেবে বিজেপির যে আত্মপ্রকাশ ঘটে, পরের ৩০ বছরের রাজনীতির মানচিত্রকেই বদলে দেয়। জ্যোতি বসু পরে বিজেপির সঙ্গে মঞ্চ ভাগাভাগির বিপদ টের পেয়েছিলেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সাংসদ, কাটোয়ার ছেলে সইফুদ্দিন চৌধুরী যে রাজনৈতিক লাইনের কথা বলেছিলেন, তাকে স্বীকার করে নিতে সিপিএমের আরও কোয়ার্টার সেঞ্চুরি লেগেছিল।
সইফুদ্দিনকে দলে ‘অপাংক্তেয়’ এবং তাঁর লাইনকে অকেজো করতে গিয়ে সিপিএম কার্যত ঘুরিয়ে গত ২৫ বছর ধরে বিজেপিকেই মদত দিয়েছে। আজ অবশ্য সীতারাম ইয়েচুরি বা সূর্যকান্ত মিশ্রদের কংগ্রেসের হাত ধরতে কোনও অসুবিধে নেই। তাঁরা মুক্ত কণ্ঠে বলেনও, বিজেপি এবং কংগ্রেসের থেকে সমদূরত্বের লাইন আর চলবে না। ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপিকে প্রতিহত করতে ‘বুর্জোয়া’ কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা অনেক শ্রেয়।
কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে কারা একটি ‘বুর্জোয়া’ দল, এবং কারা ‘সাম্প্রদায়িক’, কারা ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে দেশে দাঙ্গা বাঁধাতে পারে, এটা চিহ্নিত করতে বামপন্থীদের ৩৫ বছর লাগলো। আজ, ২০২১-এর এই মহাগুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগেও সিপিএমের কাছে তাই মমতা যত বড় ‘শত্রু’, যে তাঁকে হারাতে এমন কি ফুরফুরা শরিফের আব্বাস সিদ্দিকির মতো নেতার সঙ্গে সমঝোতা করতেও দ্বিধা হলো না।
হয়তো আজ থেকে আরও ২০ বছর বাদে, যখন সিপিএম শুধুমাত্র বইয়ের পাতাতেই রয়ে যাবে, তখন দলের তাত্ত্বিকরা স্বীকার করবেন, একসময় হিন্দু ‘সাম্প্রদায়িক’ শক্তির সঙ্গে হাত মেলানোটা তাঁদের যত বড় ভুল ছিল, ২০২১-এ মুসলিম ‘মৌলবাদী’ দলকে ‘মেইনস্ট্রিম’ রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়াটা তত বড়ই ‘পাপ’ ছিল। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় তো নয়ই, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও এদেশের বামপন্থীরা কোনও দিন তাত্ত্বিক দিক থেকে সঠিক অবস্থান নেয়নি, তাই আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে আজ হইচই করছেন।
একমাত্র নির্বাচনে জেতার চেষ্টা ছাড়া আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে কোন রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে বামপন্থীরা জোট করছেন, সেটা কেউ ব্যাখ্যা করেননি। সূর্যকান্ত মিশ্র বা সুজন চক্রবর্তীরা কি তাহলে এখন থেকে মার্ক্স-লেনিনের পাশাপাশি জাকির নায়কের ছবিও নিজেদের দলীয় দফতরে সাজিয়ে রাখবেন? আব্বাস সিদ্দিকি মুসলিম মহিলাদের নিয়ে যে মতামত পোষণ করেন, যে সব বিধিনিষেধের বেড়াজালে মহিলাদের বাঁধতে চান, সেই বিষয়ে প্রগতিশীল বামপন্থীদের কী বক্তব্য? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো শুধু ইদের নামাজে গিয়ে মাথায় কাপড় দিয়েছিলেন, এ রাজ্যের সিপিএম তো ভোট পাওয়ার আশায় ‘কট্টরপন্থী’ ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা করে নিল।
আব্বাস সিদ্দিকিকে ব্রিগেডের মঞ্চে ‘জামাই’ আদর করার পর বামপন্থীরা কোন আদর্শের বড়াই করতে পারেন, ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতারা আর কীভাবে নিজেদেরকে সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক ‘উত্তরসূরী’ বলে দাবী করতে পারেন?
অন্ধভাবে কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে একসময় এই বামপন্থীরা আরএসএস-কে রাজনৈতিক ‘মান্যতা’ দিয়েছিল, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপিকে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাব বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। আবার পশ্চিমবঙ্গে একই ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে সিপিএম আজ আর এক ধর্মীয় মৌলবাদের ‘জিন’-কে বোতল থেকে বার করে এনে ব্রিগেডে তারকা হওয়ার সিলমোহর দিচ্ছে।
জ্যোতি বসু তাঁর বিখ্যাত সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেছিলেন, কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে চলা ‘যুক্তফ্রন্ট’-এর প্রধানমন্ত্রীত্ব না নেওয়াটা সিপিএমের ‘ঐতিহাসিক’ ভুল ছিল। আজ আবার সিপিএম একই রকম ঐতিহাসিক ভুল করলো আব্বাস সিদ্দিকিকে রাজনৈতিক দিক থেকে স্বীকৃতি এবং মর্যাদা দিয়ে।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.