সুমন ভট্টাচার্য : অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করলে নির্বাচনের আগে বিজেপির লাভ, না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও আক্রমনাত্মক রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে যাবেন? ‘ভাইপো’কে গ্রেফতার করিয়ে দিতে পারলে তৃণমূলের মেরুদন্ড ভেঙে যাবে, না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক শহিদের মর্যাদা নিয়ে ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে যাবেন?
বিধানসভা ভোটের ঠিক মুখে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে সিবিআই-এর জেরা বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক জল্পনাকে উস্কে দিয়েছে। কেন্দ্রের শাসক দল অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই আড়ালে আবডালে বলে আসছে, বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে ‘চরম আঘাত’ হানা হবে। গেরুয়া শিবিরের কৌশল অনুযায়ী, একবার নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে পরে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু হয়ে যাবে, সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসনও কমিশনের আওতায় চলে যাবে। বিজেপি শিবিরের একাংশের দাবি, কয়লা এবং গরু পাচার কান্ডের তদন্ত যেখানে পৌঁছেছে, সেই সূত্র ধরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটক করাটা সহজই হবে। কেন্দ্রের বিজেপি নেতাদের একাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গেও যাঁরা সবে ঘাসফুল ছেড়ে পদ্মফুলের দিকে গিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন অভিষেককে জেলে পুরতে পারলেই তৃণমুলের মেরুদন্ড ভেঙে যাবে। ভগ্ন মনোরথ তৃণমুলকে তাহলে বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত করা বিজেপির পক্ষে সহজ হবে। গেরুয়া শিবিরের একাংশ যেহেতু এই কৌশলের ‘সাফল্য’ নিয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিন্ত, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতিমধ্যেই সিবিআই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি পৌঁছে তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত সেরে ফেলেছে।
কেন্দ্রের শাসক দল এই পরিকল্পনা নিয়ে এতটাই নিশ্চিত যে নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বিজেপির শীর্ষ নেতারা বার বার পশ্চিমবঙ্গে আসছেন এবং সরকারি খরচে তুমুল প্রচার চলছে মোদী সরকার পশ্চিমবঙ্গের জন্য কী কী করেছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ জিততে কতটা মরিয়া সেটা বোধহয় এই প্রচারাভিযানই বলে দিচ্ছে। এর আগে ভারতবর্ষের কোনও একটি রাজ্যকে জেতবার জন্য কোনও কেন্দ্রীয় সরকারকে সেই রাজ্যের জন্য তার পারফরমেন্সকে তুলে ধরে এই রকম বিজ্ঞাপন অভিযান চালাতে হয়েছে বলে জানা নেই। রাজ্য নির্দিষ্ট করে সেই রাজ্যের জন্য কেন্দ্র কি কি করেছে, তা যখন ক্রমাগত বলা হতে থাকে, তখন বিজেপির মরিয়া ভাবটা আরও সামনে এসে পড়ে।
বিহারে কান ঘেসে জেতা, কৃষক বিক্ষোভকে এখনও নিয়ন্ত্রনে না আনতে পারা এবং ক্রমাগত পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়ে যখন অর্থনীতিকে চাপের মুখে রেখেছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে জয় যে গেরুয়া শিবিরকে অক্সিজেন দেবে সেই নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তৃণমূল সেই জন্যই মনে করছে বাংলা জিততে মরিয়া বিজেপি ‘ছল-বল-কৌশল’ কোনও কিছুরই অভাব রাখবে না।
কিন্তু যে কোনও কৌশলেরই পাল্টা অভিঘাত হতে পারে। যদি বিজেপি তৃণমুলকে দুরমুশ করার লক্ষ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটক করার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি নির্দেশ দেয় এবং সেই অনুযায়ী সিবিআই এগোয়, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি করবেন? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে চিঠি এবং জেরার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রকম চুপ করে রয়েছেন, তাতে তৃণমূল সুপ্রিমো কি রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারেন তাও জল্পনার বিষয়। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিকে বিচার করতে গেলে, সবসময় মনে রাখতে হবে তিনি আদতে ‘স্ট্রিট ফাইটার’। অর্থাৎ রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদের রাজনীতিটাই তিনি ভালো করেন।
হাজরার মোড়ে মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে যে লালু আলম দক্ষিন কলকাতার এক নেত্রীকে সর্বভারতীয় স্তরে পরিচিত এবং বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন, সেই ঘটনার পারম্পার্য মনে রাখলে পরে তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক যাত্রাপথকে বুঝতে হবে। ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতনে সেদিনের সিপিএমের দাপুটে কর্মী লালু আলমের দাদা, যিনিও একসময় দক্ষিণ কলকাতার বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে লাল ঝান্ডা নিয়ে নেতৃত্ব দিতেন, সেই বাদশা আলমও এখন বিজেপিতে। আর লালু আলমের বৌদি, প্রাক্তণ বামপন্থী চান্দ্রেয়ী আলম এখন গেরুয়া শিবিরের ‘তাত্ত্বিক মুখ’। তাহলে বিজেপি শিবির কি হোমওয়ার্ক সেরে রেখেছে যে ‘বডি-ব্লো’ বা শারিরীকভাবে আঘাত করলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেন?
লালু আলমের লাঠির বাড়ি যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাস্তায় নেমে লড়াকু আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, এবার কেন্দ্রের শাসকদল যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর পরিবারকে একইরকমভাবে নিশানা করেন, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে রাজনৈতিক প্রতি হিংসার শিকার প্রমাণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না তো? এবং সেক্ষেত্রে বাঙালির সহানুভুতি ভোট তৃণমুল নেত্রী কি পেয়ে যেতে পারেন? রাজনীতি যেহেতু সবসময় ‘অসম্ভব’ এর কথা বলে, তাই কেন্দ্রীয় সংস্থার তৎপরতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘রাজনৈতিক শহিদ’ বানিয়ে দেবে না তো?
এই সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আগামী কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই দিতে পারবে। বিজেপি তাদের কৌশলে সফল হবে কিনা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারকে নিশানা করার দৌলতে বিজেপি তৃণমূলের কোমর ভেঙে দিতে পারবে, না, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর আগের রণংদেহী মেজাজে ফিরে যাবেন, সেই সব রাজনৈতিক সমীকরণের দিকেই সকলের চোখ থাকবে।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.