সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: ধর্মঘট বললেই আঙুল ওঠে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের দিকে । কিন্তু শুধু ধর্মঘট এখানেই হয় এমন ধারণাটা ঠিক নয়৷ দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলে খ্যাত বম্বেতে( অধুনা মুম্বই)ও রীতিমতো ধর্মঘট হয় ৷ বিশেষত আজ থেকে চার দশক বছর আগে সেখানে কাপড়ের কারখানাগুলিতে এমন ধর্মঘট হয়েছিল যা এদেশের ধর্মঘটের ইতিহাসে অন্য মাত্রা পায়৷ কারণ টানা বছর খানেক ধরে চলা সেই ধর্মঘট দেশের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ধর্মঘট বলে চিহ্নিত ৷ কারখানার শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে ১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা দত্তা সামন্তের নেতৃত্বে ওই ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল যাতে ৬৫টি টেক্সটাইল মিলের প্রায় আড়াই লক্ষ শ্রমিক সামিল হয়েছিল৷

১৮৮৭ সালে বম্বেতে প্রথম কাপড়ের কল স্বদেশি গড়ে ওঠে ৷ তারপরে কয়েক দশক ধরে এই বন্দর শহরে আরও কত কাপডের কল খুলেছে ৷ দীর্ঘদিন ধরে এই সব কারখানায় শ্রমিকদের স্বীকৃত ইউনিয়নটি ছিল রাষ্ট্রীয় মিল মজদুর সংঘ (আরএমএমএস) ৷ এই সংগঠনটি হল কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসির অনুমোদিত৷ এদিকে ১৯৮১ সালে শ্রমিক নেতা দত্তা সামন্ত তৎকালীন বম্বের শ্রমিকমহলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ৷ তার কিছুদিন আগে সামন্তের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সক্ষম হয়েছিল তাদের উচ্চ হারে বেতন বাড়াতে৷ বিশেষত প্রিমিয়ার অটোবোমাইলস-এর কারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দেখে ওইসব কাপড়ের কলের শ্রমিকরা তাদের পুরনো রাষ্ট্রীয় মিল মজদুর সংঘ-এর বদলে দত্তা সামন্তের দিকে ঝুঁকতে থাকে৷

এই দত্তা সামন্ত আবার বেশির ভাগ মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘ডাক্তার সাহাব’ বলে৷ কারণ তিনি ডাক্তারি পাশ করে প্রাক্টিস শুরু করলে তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আসত বেশির ভাগই কারখানার শ্রমিকরা৷ আর এই সব শ্রমিকদের চিকিৎসা করার পাশাপাশি তাদের প্রতিদিনের সংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে উজ্জীবিত হন ওই সব মানুষদের দাবি দাওয়ার জন্য লড়াই করতে ৷ তিনি যোগ দেন জাতীয় কংগ্রেস এবং তার শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি-তে৷ ৬০-৭০ দশকে বম্বেতে প্রায়ই ধর্মঘট দেখা যেত৷ আর সেই সব ধর্মঘটের অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন এই দত্তা সামন্ত৷ কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে জিতে ১৯৭২ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভার সদস্য হন৷ কিন্তু কংগ্রেসের নেতা হওয়া স্বত্তেও তাঁর আচরণের জন্য জরুরি অবস্থার সময় দত্তা সামন্তকে জেলে যেতে হয়৷ ১৯৭৭ সালে জনতা জমানায় তিনি জেল থেকে ছাড়া পেলে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন৷

কাপড়ের কলের শ্রমিকেরা ক্রমশ রাষ্ট্রীয় মিল মজদুর সংঘ থেকে সরে এসে ডাক্তার সাহাবকে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করে৷ তখন তিনি আগের ধর্মঘটের ফল কি তার জন্য অপেক্ষা করতে বললেও শ্রমিকরা কোনও রকম অপেক্ষায় রাজি ছিল না উল্টে জোরদার ধর্মঘটে নেমে পড়তে চায় ৷ ফলে সামন্তের নেতৃত্বে শুরু হয় ধর্মঘট- ওই সব কাপড়ের কলগুলিতে উৎপাদন থেমে যায়৷ বেতন ও বোনাস বৃদ্ধির পাশাপাশি কাজের পরিবেশ উন্নতির দাবিতে যেমন লড়াই করছিলেন তেমনই আবার আরএমএমএস-কে একমাত্র ইউনিয়নের স্বীকৃত বাতিল করতে বলা হয়৷

তখনও সামন্তের সঙ্গে কংগ্রেসের যোগ থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সহ বেশ কিছু নেতা তাঁর জনপ্রিয়তাকে ভাল চোখে দেখেন নি বরং রাজনৈতিক ত্রাসের কারণ হিসেবেই মনে করেছিলেন৷ ভয় পেয়েছিলেন যদিও এই কাপডের কলগুলির শ্রমিকদের দাবি দাওয়া মেনে নেওয়া হয় তাহলে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে এই শ্রমিক নেতাটির জনপ্রিয়তা শুধু বাড়বে না, রেল, বন্দর প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিকরাও উৎসাহ পেয়ে যাবে ধর্মঘট করে বেতন বাড়িয়ে নিতে৷ ফলে কোনও রকম শ্রম নীতিগত কারণে নয় পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারের দিক থেকেও সহমর্মিতার বদলে কঠোর মনোভাব অবলম্বন করা হয়৷

এদিকে এই ধর্মঘট চলতে থাকায় অথচ দাবি দাওয়া না মেটায় শ্রমিকদের উৎসাহে ভাটা পড়তে থাকে৷ বিশেষত শিবসেনা এই ধর্মঘটে শ্রমিকদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে৷ বেশ কিছু মিল মালিক ওই সময় তাদের কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায় ৷ ফলে দিন যত যায় এই ধর্মঘট ততই গুরুত্ব হারাতে থাকে৷ ধর্মঘটীদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতের জেরে ধর্মঘট ভাঙলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না৷ বরং বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছিল৷
তাছাড়া প্রিমিয়ার অটোমোবাইলস-এর মতো এইসব কাপডের কলগুলি আর্থিক অবস্থা ততটা ভাল ছিল না, বিশেষত ব্যালান্স শিটে এরা রুগন বলেই প্রতিফলিত হচ্ছিল ৷ তার কারণ অবশ্য মিল মালিকেরা তাদের কারখানার মেশিন পত্র আধুনিকীকরণ করেননি ৷ তাছাড়া পরবর্তীকালেও দেখা গিয়েছিল এই মিল মালিকেরা নিজেদের কারখানাকে রুগন দেখিয়ে সরকারের কাছে উদ্বৃত্ত জমি বেচার অনুমতি চায় এবং সরকার তা দিলে জমি বেচে কিন্তু সেই টাকা আর মিলের উন্নতিতে ব্যবহার করা হয় না৷

সেসময়ের এই দীর্ঘদিনের ধর্মঘট যেমন মুম্বইয়ের শিল্প ভাবমূর্তি খারাপ করেছিল তেমনই আবার এমন দীর্ঘদিন ধরে চলা ধর্মঘট ব্যর্থ হওয়ায় দেশজুড়ে শ্রমিকদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে দিয়েছিল৷ ওই ধর্মঘটকে অজুহাত করে বেশ কিছু মিল মালিক বম্বে ছেড়েছিল তাদের অনেকেই তখন মিলের জমিকে রিয়েল এস্টেটের কাজে লাগায়৷ তবে সেদিনের ওই ধর্মঘট ব্যর্থ হলেও ডাক্তার সাহেবের জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল সেটা অবশ্য কখনই বলা চলে না৷ একদল শ্রমিকের কাছে তখনও তিনি জনপ্রিয় ঠিকই ছিলেন তাই তার কিছু দিন পরে ১৯৮৪ সালে লোকসভা ভোটে নির্দল প্রার্থী হয়েই তিনি ভোটে জেতেন৷ যদিও তার কিছুদিন আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেহরক্ষীর গুলি নিহত হওয়ায় কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতি হাওয়ায় সেবার ভোটে নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস৷

লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'! 'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.

সিনেমার বড় পর্দা থেকে টেলি পর্দার জগতে কতটা সম্মান পাচ্ছেন মেয়েরা? জানাবেন মিডিয়া টিচার অনুজা বাগচী।