সুমন ভট্টাচার্য: নেতাজীর ঘোড়ায় চাপা মূর্তি আর গোলবাড়ির কষা মাংস। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের এই দুটোই ‘ল্যান্ডমার্ক’। বীরদৃপ্ত নেতাজীর মূর্তি যদি তাঁর সেই ঐতিহাসিক ‘দিল্লি চলো’র ডাককে মনে করিয়ে দেয়, তাহলে গোলবাড়ির কষা মাংসের কৃষ্ণকালো ঝোল ‘আইকনিক’। ‘ব্লাক গ্রেভি ম্যাটারস’। কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে আবার গোলাবাড়ি হাজির তার সেই বিখ্যাৎ পরোটা আর কষা মাংস নিয়ে। নতুন চেহারার এই ‘ফুড আউটলেট’-এর অনেক স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে, কিন্তু কষা মাংসের গ্রেভি কতটা স্বাস্থ্যকর, এই সব ‘অবাঞ্ছিত’ অহেতুক প্রশ্ন করে খাদ্য রসিকদের মেজাজ খারাপ করে দেওয়া যাবে না। উত্তর কলকাতার এই কিংবদন্তীসম খাওয়ার দোকানের আসল আকষণই তো ওই কালো, পুরু গ্রেভি, যা চার টুকরো মাংসের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। গোলবাড়ির মেনু চার্ট অনুযায়ী যার নাম ‘এক কোয়ার্টার কষা মাংস’।
কলকাতা শহরে যাঁরা খাদ্য রসিক, তাঁরা গোলবাড়ির এই বিখ্যাৎ কষা মাংস আর পরোটা উদরস্থ করেননি, এমনটা হতে পারে না। ঠিক শ্যামবাজারের মোড়ে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড আর কলেজ স্ট্রিটের সংযোগস্থলে এই রেস্তোরার খ্যাতিই হচ্ছে পরোটা আর কষা মাংসের জন্য। এমনিতে বসে খাওয়ার জন্য জায়গা যথেষ্ট কম, কিন্তু তাও আমার মতো যে পেটুকরা খাবেনই, তাঁদের জন্য পরোটা আর কষা মাংসের সঙ্গে রয়েছে চাটনি আর পেয়াজ। নরম তুলতুলে পরোটা যখন কালো থিকথিকে গ্রেভি আর চাটনিতে মাখিয়ে আপনি মুখে দেবেন, তখন সেই স্বাদ সত্যিই ‘অমৃত’। গোলবাড়ির কষা মাংসের দোকানের ইতিহাস প্রায় শতবর্ষ ছুইছুই, আর আমিও এই ‘কষা কোয়ার্টার’-এর স্বাদ চাখছি প্রায় হাফসেঞ্চুরি সময় ধরে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এই অর্ধশতকে ‘কষা কোয়ার্টার’-এর দাম হয়তো বেড়েছে দশ গুন, কিন্তু ওই কৃষ্ণকালো গ্রেভি কোনও ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ দিয়ে ফর্সাও হয়ে যায়নি, কিংবা মিহিও হয়নি।
যাঁরা ‘গোলাবাড়ি’র স্বল্প পরিসরে বসে খেতে স্বচ্ছন্দ নন, তাঁদের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই প্যাকেটে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আর এখন বিভিন্ন হোম ডেলিভারির অ্যাপের সৌজন্যে, অর্থাৎ ‘স্যুইগি’ বা ‘জোমাটো’র দৌলতে গোলবাড়ির কষা মাংস পৌঁছে যাবে আপনার বাড়িতেও। এই কষা মাংস কিন্তু ভাতের সঙ্গে তেমন মানানসই নয়। বুমরার সঙ্গে সামির জুটির মতো ওই তুলতুলে পরোটা চাই-ই-চাই। এক কোয়ার্টার মাংস আর তিনটে পরোটা যে কোনও একজনের পেট ভরানোর জন্য যথেষ্ট। তবে এই কষা মাংসের আবেদন এমন তীব্র এবং মাদকতাময়, যে পরোটা বাড়লেই বা ক্ষতি কি?
আমাদের যাঁদের ছোটবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতায়, তাঁদের অনেকেরই হয়তো শৈশব বা কৈশরের স্মৃতি আছে বাড়িতে এই কোয়ার্টার মাংস আর পরোটা নিয়ে এসে ভুড়িভোজ করার। সেই ছোটবেলায় মাটির ভাঁড়ে লেগে থাকা কষা মাংসের গ্রেভি পরোটা দিয়ে চাখার স্মৃতি এখনও টাটকা যে কখনো কখনো গ্রেভির সঙ্গে সঙ্গে ভাঁড়ের ‘আস্তরণ’ও মুখে চলে যেত, সেটাও মনে আছে। গোলাবাড়ির কষা সেই সময় থেকে বিখ্যাৎ যখনও জুকেরবার্গ জন্মাননি, ফেসবুক তো শুধুমাত্রই স্বপ্ন। ইন্টারনেট, ট্যুইটার বিহীন সেই পৃথিবীতে গোলাবাড়ির কষা সবসময়ই সর্বোচ্চ রেটিং পেয়ে এসেছে। আজকের এই পৃথিবীতে সেই কষা মাংস যখন বাড়িতে পৌঁছায়, তখন ‘ডিসপোজেবল’ প্যাকেট থাকে ঠিকই, কিন্তু ওই কৃষ্ণকালো গ্রেভির আকর্ষণ এখনও অটুট। বরং ভালো স্কচ যেমন বয়সে যত বাড়ে, স্বাদে গন্ধে তত অতুলনীয় হয়, আজ এই ৯০ পেরিয়ে যাওয়া ‘ফুড আউটলেট’-এর কষা মাংসও যেন আরও আকর্ষনীয় হয়েছে।
গোলবাড়ির কষা মাংস কেন এত বিখ্যাৎ? আসলে ওই থিকথিকে কালো গ্রেভির জন্যই। কোন্ যাদুমন্ত্রে যে ওইরকম রগরগে, গরগরে গ্রেভি বছরের পর বছর ধরে গোলবাড়ি বানিয়ে আসছে, সেটাই আসলে সবচেয়ে বড় রহস্য। এবং সেই রহস্যেই আপামর বাঙালি মন্ত্রমুগ্ধ। শুধু রেসিপি জেনেই তো ওই থিকথিকে গ্রেভির রহস্য ভেদ করা সম্ভব নয়, তার সঙ্গে নিশ্চয়ই আছে রাঁধুনিদের হাতের জাদু। নব্বুই বছর ধরে যে যাদু ধরে রাখতে গেলে একটা পরম্পরা বা ঐতিহ্যের দরকার। গোলবাড়ি নামক আদতে ‘পাঞ্জাবি হোটেল’টি সেই পরম্পরা বা ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
এমন নয় যে গোলবাড়িতে অন্য পদ পাওয়া যায় না, মাটন ডেভিল থেকে ফিস ফ্রাই, সবই মেলে। আছে মাটন কিমা কিংবা চিকেন লিভারও। সবই সুস্বাদু, অতি উপাদেয়। কিন্তু ভগবৎ চন্দ্রশেখরের যেমন তুরুপের তাস ছিল ‘স্লোয়ার’ বা শেন ওয়ার্নের ‘গুগলি’, তেমনিই গোলবাড়ির মাটন কষা মাংস আর পরোটা।l
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.