‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র নায়ক যেদিন চলে গেলেন, সেদিন নায়িকা কোথায়? কোথায় মন্দাকিনী? গত চল্লিশ বছরে ভারতীয় পুরুষদের আর কেউ যেভাবে আলোড়িত করে যাননি, রাজ কাপুরের সেই নায়িকা কোথায়? আর পাহাড়ি ঝোরায় স্নান করতে গিয়ে যিনি আসমুদ্র হিমাচলকে ভিজিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মন্দাকিনী নাকি যাঁর বান্ধবী ছিলেন, সেই দাউদ ইব্রাহিমেরই বা খবর কি?

লিখলেন– সুমন ভট্টাচার্য

মঙ্গলবার রাজকাপুরের কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু সংবাদ আসার পর সারাদিন ধরে অপেক্ষায় থেকেছি কখন ইয়াসমিন যোসেফ ওরফে মন্দাকিনীর কোনও প্রতিক্রিয়া আসবে। মালদ্বীপে ছুটি কাটানো সেরে আজকের ‘হার্টথ্রব’ আলিয়া ভাট চলে গিয়েছেন প্রেমিক রণবীর কাপুরের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু তামাম ভারতীয় পুরুষদের যিনি সাবালক করলেন, ৮০র দশকের সেই হৃদয়ের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে দেওয়া নায়িকার কোনও ট্যুইট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট নেই?

প্রাক ইন্টারনেট যুগে যখন নায়িকাদের ছবি সিনেমা ম্যাগাজিন থেকে কেটে দেওয়ালে লাগানোই ছিল দস্তুর, সেই সময় মন্দাকিনী যে কি ঝড় তুলে দিয়েছিলেন, তা আজকে হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না। এক ফিল্ম সাংবাদিক একবার রসিকতা করে লিখেছিলেন, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের সব সেলুনে নাকি ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’তে মন্দাকিনীর সেই বিখ্যাত স্নানের দৃশ্যের ছবি লাগানো থাকতো।

সেলুনে খদ্দের টানতে ওটাই নাকি অব্যর্থ দাওয়াই ছিল। সানি লিওন আর মিয়া খলিফা যখন হাতে মুঠোয়, তখন আজকের প্রজন্মের কেউ হয়তো জানে না সাতের দশকে ইন্দিরা গান্ধীর, আর নয়ের দশকে অটল বিহারী বাজপেয়ীর করা দুই পোখরান বিস্ফোরণের মধ্যে রাজ কাপুরের এই নায়িকা কতটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন।

এটা অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই নায়িকাদের কিভাবে ‘ব্যবহার’ করতে হয়, তা রাজ কাপুরের চাইতে ভালো খুব কম পরিচালকই জানতেন। সেটা ‘মেরা নাম জোকার’-এ সিম্মি গারেওয়াল বা ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এ জিনাত আমনকে যেভাবে তিনি পর্দায় এনেছিলেন, তা মনে করলে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

কিন্তু কনিষ্ঠতম পুত্র রাজীব কাপুরকে নিয়ে তিনি যখন ১৯৮৫তে ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ বানালেন, আর মন্দাকিনী পাহাড়ি ঝোরায় বসে স্নান সারলেন, তখন বোধহয় সব রেকর্ড গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে কি গঙ্গা যে এতটা ‘মইলি’ বা অপবিত্র হয়েছে, সেটাই বা আগে আমরা কতটা জানতাম! ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ এবং মন্দাকিনী তাই পবিত্রতা, অপবিত্রতার সংজ্ঞাটাই নতুন করে তৈরি করে দিলেন।

‘পাপিও সে পাপ ধুতে ধুতে’ রবীন্দ্র জৈন-এর সুর করা জনপ্রিয় এই লাইনটি যে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সমাজ-রাজনীতিতেও এত সত্যি হয়ে দাঁড়াবে, তাও বোঝা যায়নি আটের দশকের শেষদিকে মন্দাকিনী এবং দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শুরু হওয়ার আগে।

গঙ্গাকে কোন্ পাপী ‘অপবিত্র’ করেছিল, সেই বিষয়ে কেউ নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র গঙ্গা ওরফে মন্দাকিনী যে দাউদ যোগেই বলিউড ছেড়েছিলেন, সেই বিষয়ে সবাই নিশ্চিত ছিল। দাউদের সঙ্গে মন্দাকিনীকে ঠিক কোথায় কোথায় দেখা গিয়েছে, কিংবা কোন্ মরুশহরের ক্রিকেট আসরে ‘ডি কোম্পানি’র ‘সিইও’-র পাশে বলিউডের এই নায়িকা বসেছিলেন, তা নিয়ে এক সময় নিরন্তর চর্চা চলত।

ছোটবেলায় যাবতীয় বকুনি অগ্রাহ্য করে ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ দেখাটা যেমন আজকের দিনে হাতে স্মার্টফোন রাখার মতো বাধ্যতামূলক ছিল, ঠিক তেমনই কতজন যে গুনগুন করে গাইতো ‘ম্যায়নে তুঝে চুন লিয়া, তু ভি মুঝে চুন’। সাংবাদিকতার সূত্রে বা যেকোনো কারণেই হোক, যতবার মুম্বাইতে গিয়েছি, ততবার যেমন একবার করে দাউদের পরিত্যক্ত হাভেলি দর্শন করে বোঝবার চেষ্টা করেছি কিভাবে রিমোট কন্ট্রোলে এই বাড়ির মালিক নিয়ন্ত্রণ করতেন গোটা ভারতের অপরাধ সাম্রাজ্যকে। দাউদ কি শুধু অপরাধের ‘মাস্টার মাইন্ড’ ছিলেন, তাঁর অঙ্গলিহেলনে তো বলিউডের অনেক নায়ক কিংবা নায়িকার ভাগ্য নির্ধারণও হতো।

এক সময় বলিউডের গুঞ্জন ছিল দাউদের ইচ্ছাতেই নাকি মন্দাকিনী রুপালি পর্দাকে বিদায় জানিয়েছিলেন। সেই গুঞ্জনকে মিথ্যা প্রমাণ করবার জন্য পরবর্তীকালে রাজীব কাপুরের সঙ্গে তুমুল হিট দেওয়া নায়িকা মুম্বাইতে ফিরে এসে এক প্রাক্তন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে বিয়ে করেন। কিছু ছোটখাটো কাজও হাতে নেন। মুম্বাইয়ের অপরাধজগৎ এবং বলিউডের সুলুক সন্ধান জানেন এমন ‘অভিজ্ঞ’ লোকরা অবশ্য বলেন, এই সবই দাউদ এবং তাঁর চালানো সাম্রাজ্যের পুলিশ এবং প্রশাসনকে ‘চোখে ধুলো দেওয়া’র চেষ্টা। যেহেতু গত শতকের নয়ের দশক থেকে ভারতবর্ষের পুলিশ এবং বিভিন্ন সংস্থা ‘ডি কোম্পানি’র উপর চাপ বাড়াতে শুরু করে, তাই দাউদ ইব্রাহিম তাঁর ‘বান্ধবী’কে ভারতবর্ষে ফেরত পাঠিয়ে দেন।

রাজীব কাপুরের মৃত্যু তো শুধু কাপুর খানদানের এক ‘ফ্লপ’ নায়কের চলে যাওয়া নয়, ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’র মতো ব্লকবাস্টার সিনেমার নায়কের মৃত্যুও। সেই মৃত্যুতে, নায়কের বিদায়ে তাঁর সবচেয়ে বিখাত নায়িকার কাছ থেকে কোনও শোকজ্ঞাপনও আসবে না? এখনও কি দাউদ ঠিক করে দেন মন্দাকিনীর প্রতিটি পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তকে? কত হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও রিমোট কন্ট্রোলে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর পছন্দের সবকিছুকে?

লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'! 'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের। কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.

Caption: Work from Home এর বাস্তব ছবি নিয়ে আলোচনায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনিরুদ্ধ দেব।