সুমন ভট্টাচার্য: ‘পোয়েটিক জাস্টিস’।
সোমবার দুপুরে সৌমেন মিত্রের পুলিশ কমিশনার পদে দায়িত্বগ্রহনের ছবি দেখতে দেখতে এই শব্দটার কথাই প্রথম মনে এল। এবং মনে হল, ‘কাব্যে উপেক্ষিত’রাও কখনও কখনও এইভাবে ফেরত আসতে পারেন। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যিনি জাতীয়তাবাদ এবং ভারতের খেলাধূলা নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেই কৃতি ছাত্রের এইদিনের সাংবাদিক সম্মেলন ছিল একেবারে মাপা। মনে হচ্ছিল, ‘রুট’ বাহিনীর সামনে কিভাবে ব্যাটিং করতে হয়, তা ভারতীয় ক্রিকেট দল কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে শিখে নিতে পারে। কোনও প্রশ্নকে ‘গুড লেংথ’ উচ্চতায় উঠতেই দেবেন না, সুদর্শন আইপিএস রিমলেস চশমা দিয়ে সমস্ত বলকে, থুড়ি, প্রশ্নকে হাঁটুর নিচে রেখে গেলেন।
সময় যেদিন ‘কাব্যে উপেক্ষিত’কে ফিরিয়ে আনে, মানে যেদিন কর্ণের রথের চাকা কোনও কৃষ্ণ মাটিতে বসিয়ে দেন না, সেদিন আপনার এত দিনকার ‘অর্জুন’-এর কথা মনে পড়বেই। লালবাজারের কর্তা হিসাবে সৌমেন মিত্রের প্রত্যাবর্তনের দিনে কোথায় রাজীব কুমার? এতদিন তো সেই ‘অর্জুন’-এর জন্যই ‘কর্ণ’রূপী সৌমেন মিত্রের চাকা বারবার বসে যেত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজীব কুমারকে সচিব পদে সরিয়ে দেওয়ার পর তিনি এতটাই আড়ালে চলে গেছেন যে এই দিন পুলিশ প্রশাসনে যাঁকে তিনি বার বার টপকেছেন, সেই সৌমেন মিত্র যখন আবার পুলিশ কমিশনারের পদ ফিরে পেলেন, তখন চার্লস টেগার্টের পরে কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাক্তন কমিশনারের কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই।
সোমবারের দৃশ্যের সঙ্গে ২০১৬-র আর একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ছিল। বিপুল ভোটে ক্ষমতায় জেতার পর কালিঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন সেদিনের কলকাতার পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র। ভুল বললাম, তৃণমূল নেত্রীর পছন্দের রাজীব কুমারকে সরিয়ে নির্বাচন কমিশন যাঁকে কলকাতার নগরপাল করেছিল, সেই সৌমেন মিত্র। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য যাঁর দিকে প্রশংসার বন্যা ধেয়ে গিয়েছিল, সেই সৌমেন মিত্র ২০১৬তে কালিঘাটে তৃণমূলের বিজয় উৎসবের দিনে ‘অনাহুত’ ছিলেন। আবার জিতে ফিরে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সৌমেন মিত্রের নিয়ে যাওয়া ফুলের তোড়াটাকেও ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। মাথা নিচু করে কালিঘাট থেকে যখন সৌমেন চলে আসছিলেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন ৩০বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পৌঁছে গিয়েছেন রাজীব কুমার। ২০১৬তে ওই জেতার দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম যে নির্দেশ জারি করেছিলেন, সেটা সৌমেন মিত্রকে সরিয়ে আবার রাজীব কুমারকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার করা।
তাহলে কি এমন হল ২০২১-র এই মহা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে সেই তৃণমূল নেত্রী কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদে সৌমেন মিত্রকে ফিরিয়ে আনলেন? রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে যে দুটো সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা শোনা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালোই জানেন, একবার নির্বাচনী বিধি চালু হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশন তাঁর এতদিনের ‘প্রিয়পাত্র’ অনুজ শর্মাকে সরাবেই। এবং নির্বাচন কমিশনের পছন্দের তালিকায় সৌমেন মিত্রই উপরের দিকে থাকবেন। তাহলে তিনি, অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন আগে থেকে সেই ‘কাব্যে উপেক্ষিত’কে এনে যথাযোগ্য নায়কের মর্যাদা দেবেন না? আর পুলিশ এবং প্রশাসনের সবাই স্বীকার করে দক্ষ এবং সৎ অফিসার হিসাবে সৌমেন মিত্রের জুড়ি মেলা ভার। যে নির্বাচন ঘাসফুল শিবিরের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ, যে নির্বাচনের গেরুয়া শিবিরের চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশের অনেক কর্তাই রুশ কিংবদন্তী সের্গেই বুবকার চাইতে দ্রুত গতিতে ডিগবাজি মারছেন, সেখানে সৌমেন মিত্র কোনও পক্ষপাতিত্ব নাও করতে পারেন। শুধুমাত্র এতদিন ধরে তাঁর তৈরি করা ভাবমূর্তিকে রক্ষা করার জন্যই কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনার বিজেপির দিকে নাও ঝুঁকতে পারেন।
দ্বিতীয় সাম্ভাব্য ব্যাখ্যাটা হচ্ছে, সিবিআই-এর হাত থেকে গ্রেফতারি এড়াতে রাজীব কুমার যে দিল্লিতে কেন্দ্রিয় সরকারের এবং মোদী সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে নেননি, সেই বিষয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব নিশ্চিত নন। বরং সাম্প্রতিক কালে যখন তৃণমূলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ রাজীব কুমারকে আক্রমণ করে গেছেন, তখন তৃণমূল নেতৃত্ব ‘এটা ওদের দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে এড়িয়ে গিয়েছে। আড়ালে চলে যাওয়া রাজীব কুমারের প্রতি ‘আস্থা’র অভাবই কী তৃণমূল নেতৃত্বকে বাধ্য করল সৌমেন মিত্রকে বেছে নিতে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর আপাতত আমাদের কাছে অজানা। এবং নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি নতুন পুলিশ কমিশনার এইসব প্রশ্নকে চোখের থেকে চশমা নামানোর মতো করেই ঝেড়ে ফেলবেন। যাঁরা মনে করেন ‘রাফ এন্ড টাফ’ অফিসার হিসাবে রাজীব কুমারের কোনও বিকল্প নেই, তাঁরা আসলে ইতিহাসের এই ছাত্রকে ভুল চেনেন। প্রায় ২৫ বছর আগে আসানসোল থেকে তিনি যখন প্রথম কলকাতা পুলিশে আসেন, তখনই আমরা, প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর জুনিয়ররা কয়লা মাফিয়াদের কিভাবে তিনি শায়েস্তা করেছিলেন তার কিছু কিছু কাহিনী শুনেছিলাম। সেগুলোও যতটাই রোমহর্ষক, ততটাই আধুনিক ওয়েব সিরিজের প্লট হিসাবে দূর্দান্ত। কিন্তু চেহারায় এবং মমনে এতটাই বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ছাপ রয়েছে যে সৌমেন মিত্রকে নিয়ে খুব কমই ‘আখ্যান’ রচিত হয়েছে।
সোমবার মনে হল সেই অনেক না পাওয়ার, অনেক কিছু না ঘটার একটা ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বোধহয় এবার হতে চলেছে।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.