সুমন ভট্টাচার্য: শতাব্দী রায দল ছাড়ছেন? এরপরে কি লাইনে বেসুরো মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়? হুগলি এবং হাওড়ার অনেক পরিচিত বিধায়কই গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি?
শুক্রবার দুপুরে তারাপীঠ উন্নয়ন পর্ষদের পদ থেকে শতাব্দী রায়ের পদত্যাগ এবং তাঁর দিল্লি যাওয়ার খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে এইগুলোই বাংলার রাজনৈতিক মহলের গুঞ্জন| জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিতেও পরপর ব্রেকিং নিউজ, ‘তৃণমূলে আরো ভাঙনের সম্ভাবনা|’ টলিউড থেকে প্রথম যাঁরা তৃণমূলে এসে জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন, সেই তালিকায় প্রয়াত তাপস পালের সঙ্গে তাঁর বহু সিনেমার নায়িকা শতাব্দী রায়ের নামও থাকবে| তিনবার বোলপুর থেকে নির্বাচিত সাংসদ কোনোদিনই রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নন, কিন্তু রুপালি পর্দার সুবাদে পরিচিত মুখ তো বটেই| তাই টলিউডের নায়িকা, তিনবারের সাংসদ যতই পলিটিকালি লাইটওয়েট হোন না কেন, তিনি যদি বেসুরো বাজেন, তাহলে শোরগোল তো হবেই|
এটাকে যদি পারসেপশন গেম বলেন, তাহলে স্বীকার করে নিতেই হবে, সেই খেলায় বিজেপি তৃণমূলকে গোল দিচ্ছে| সাধারণ মানুষের মনে ধারণা হচ্ছে, তৃণমূল ডুবন্ত নৌকা| তাই একের পর এক নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ দল ছেড়ে অন্য জাহাজে উঠছে| এবং রাজনীতির সমুদ্রে সেই জাহাজ নিঃসন্দেহেই গেরুয়া পতাকা ওড়ানো বিজেপি|
তৃণমূলের জন্য সমস্যার বিষয় হচ্ছে, এই যে পারসেপশন গেম এ গোল তারা খাচ্ছে, সেইটা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝেও না বোঝার ভান করছে| এই বিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে শতাব্দী রায় দল ছাড়লে কোনো ভোট সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন না| দক্ষিণ কলকাতার যে অভিজাত আবাসনে প্রাক্তন নায়িকা থাকেন, সেখানেও তিনি নিজের ক্ষমতায় ভোট পাবেন না| তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া কেউ ভোট ক্যাচার নন, অধিকাংশ বড় নামই নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পাড়ার কাউন্সিলর ভোটেও জিততে পারবেন না| তৃণমূলের প্রথম রাজ্য সভাপতি, প্রয়াত পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন, সেই সময় থেকে এটাই রাজনৈতিক বাস্তব| কিন্তু পারসেপশন?
এই পারসেপশন গেম কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবকে অনুসরণ করে না| অনেকটা রামগোপাল বর্মার সিনেমার মতো, ট্রেলার দেখেই সুখ, মনে হয় নিশ্চয়ই অস্কার জিতেই থামবে!! এটা আলাদা বিষয় যে হলে গিয়ে সেই সিনেমা দেখলে আপনি ভিলেনদের মতো রামগোপালের জন্য সুপারি দিতে উদগ্র হয়ে যাবেন| কিন্তু সেটা তো রাজনৈতিক বাস্তব| সেটা কতজন জানে বা বোঝে? বিশেষ করে যে কোনো ভোটে যেখানে একটা বড় অংশের ভোটার থাকেন, যাঁরা ফ্লোটিং ভোটার বা দোদুল্যমান ভোটার, কোন দিকে পাল্লা ভারি সেটা বুঝে নিয়ে নিজের বোতামটা টেপেন| বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল নিঃসন্দেহে এই পারসেপশন গেম বা দেখনদারিত্বে তৃণমূলকে টেক্কা দিয়ে দোদুল্যমান ভোটারদের পদ্মের দিকে টেনে আনা| এবং সেই কৌশলে যে অমিত শাহ বা কৈলাস বিজয়বর্গীরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পেরেছেন, সেই বিষয়ে কোনো সংশয় রাখা উচিত নয়|
নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে এবং বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে বাংলায় বিজয় কেতন ওড়াতে ঝাঁপিয়েছে, তখন অবশ্য তৃণমূলের জন্য চ্যালেঞ্জ অনেকগুলো| পারসেপশন গেম বা দেখনদারিত্ব তার মধ্যে একটা মাত্র| রাজ্যের শাসকদলের জন্য আরেকটি অস্বস্তির বিষয়, সিবিআই বা ইডি-র সক্রিয় হয়ে ওঠা| যেহেতু চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের অনেক নেতা, মন্ত্রী এবং সাংসদের নাম অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছে, তাই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সক্রিয় হলে রাজ্যের শাসকদলের উদ্বেগে পড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে| প্রথমে অ্যালকেমিস্ট কর্তা কেডি সিংহ এবং তারপরে রোজভ্যালির মালিক গৌতম কুন্ডুর স্ত্রী শুভ্রা কুন্ডুর গ্রেফতারি যে পশ্চিমবঙ্গের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিয়েছে,তা বলাই বাহুল্য|
শতাব্দী রায়ের দলবদলের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার পর তৃণমূলের তরফে বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা যতটাই হাস্যকর, ততটাই দলকে বেআব্রু করে দেয়| সৌগতবাবু পুরনো গানের প্যারডি শুনিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, যেহেতু শতাব্দী রায়ের নামও চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রয়েছে, তাই বিজেপি সিবিআইয়ের ভয় দেখিয়ে প্রাক্তন নায়িকাকে দলে টানছে| অর্থাৎ যেটা তৃণমূল এর আগেও বারবার বলেছে, মুকুল রায় বা শোভন চট্টোপাধ্যায় গেরুয়া ঝান্ডা হাতে নিয়েছেন তদন্ত বা গ্রেফতারি এড়াতে, সেই একই প্রবণতা শতাব্দী রায়ের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে| সৌগত রায়ের মতো প্রবীণ এবং বিচক্ষণ নেতার মুখ থেকে এই ধরনের যুক্তি শোনাটা হাস্যকরই বটে, কারণ তাহলে প্রশ্ন উঠবেই, তৃণমূল যদি জানতোই এই নেতা বা সাংসদরা চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বা আইনি প্রক্রিয়ায় বিপদে পড়তে পারেন, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যবস্থা নেননি কেন? দল থেকে বহিষ্কার করেননি কেন?
সৌগত রায় বা তৃণমূল নেতৃত্ব শতাব্দী রায়ের দল ছাড়ার জল্পনার সঙ্গে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ টেনে আসলে নিজেদের দূর্বলতা প্রকট করে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন তাদের নেতা বা সাংসদরা কতটা চোরাবালির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন| এবং ভোটারদের মধ্যে প্রশ্ন জাগবেই, সিবিআই ডাকবে শুনলেই এইরকম কতজন আছেন যাঁরা তেরঙ্গা ঝান্ডা ছেড়ে গেরুয়া পতাকা ধরে নেবেন?
** মতামত সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.