সুমন ভট্টাচার্য: চমকাবেন না। করোনা পরবর্তী যে পৃথিবীতে আমরা ঢুকতে চলেছি সেখানে ভ্যাকসিন একটা বাস্তব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে এটাই শেষ ভাইরাস নয়, আরও ভাইরাস আসবে। তাহলে কি আবার ২০২০-র ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হবে? একটা ভাইরাসের ভয়ে গোটা পৃথিবীকে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে? নাকি আমরা যক্ষ্মা বা পোলিওর মতো এই ধরনের রোগের মোকাবিলায় ‘ভ্যাকসিন’কে নিজেদের জীবনের অপরিহার্য্য অঙ্গ করে তুলবো?
কেন এই প্রশ্নটা আসছে সেটা করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে যে আলোচনা বা চর্চা চলছে, সেটাকে আর একটু ঠান্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। সিরাম কর্তা আদার পুনাওয়ালা, যিনি অক্সফোর্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন ভারতে এনেছেন, এবং ভারত সরকার তাঁকে ছাড়পত্রও দিয়েছে, তিনি বলেই দিয়েছেন মার্চ থেকে বেসরকারী হাসপাতাল বা বিভিন্ন ‘কর্পোরেট’ এই ভ্যাকসিন পেতে পারবে। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা ইতিমধ্যেই যেভাবে পুনাওয়ালার সিরামের কাছে নিজেদের ‘অর্ডার’ দিনে শুরু করেছে তার থেকে পরিষ্কার ভারতবর্ষের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বাজারের ঠিক করে দেওয়া দাম অনুযায়ী টাকা দিয়ে এই ভ্যাকসিন কিনবেন এবং টিকা নেবেন। ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে ১৩০ কোটি মানুষের বাস, সেখানে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে সরকারের টিকাকরণ কর্মসূচীর জন্য অপেক্ষা করবে না, সেটা কোনওরকম গবেষণা ছাড়াই বলে দেওয়া যায়। সেইজন্যই মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভ্যাকসিন কবে আসছে এবং কবে থেকে টিকাকরণ শুরু হচ্ছে, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল।
যোসেফ স্টিগলিজ-এর মতো অর্থনীতিবিদ বা অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী যেটা চেয়েছিলেন, বিশ্বের সব দেশের সব মানুষ বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন পান, ‘পিপিলস ভ্যাকসিন’, সেটা আসলে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অতি বামপন্থী এবং অতি ডানপন্থীরা মনে করেন, সবাইকে যে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না, তার কারণ তথাকথিত ‘ভ্যাকসিন লবি’ বা ঔষধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির চাপ। স্টিগলিজ যে দাবিটা তুলেছিলেন, করোনার ভ্যাকসিনে কেউ পেটেন্ট নিতে পারবেন না, সেটা মানা হয়নি। কারণ মনে করা হয়, আমেরিকায় ফাইজারের মতো সংস্থাগুলি ভ্যাকসিন থেকে যে বিলিয়ন ডলার মুনাফা করে, তাহলে সেটা হতে পারতো না।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে অবশ্য ভ্যাকসিন বা টিকাকরণ নতুন কোনও বিষয় নয়। আমাদের দেশে যক্ষ্মা বা পোলিওর জন্য গণটিকাকরণের কর্মসূচি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। করোনার সময়ও নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষকের সমীক্ষা বলেছিল, ভারতবর্ষের গণটিকাকরণ কর্মসূচী হয়তো আমাদের শরীরে ‘ইমিউনিটি’ তৈরি করতে সাহায্য করেছে। করোনা আসার আগেই ২০১৮তে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বাজেট প্রস্তাবে ২০২২ অবধি ৫২ হাজার কোটি টাকা ভ্যাকসিন খাতে খরচ করা হবে বলে রাখা হয়েছিল। তাই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সিরাম কর্তা আদার পুনাওয়ালা যখন ভারতবর্ষে টিকার জন্য খরচ কে দেবে, ট্যুইট করে এই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয় খেয়াল রেখেছিল, ভ্যাকসিন খাতে খরচ করার জন্য তাদের কাছে কতটা অর্থ রয়েছে।
কিন্তু ভারতবর্ষ ১৩০ কোটির দেশ, সরকারকে যদি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দিতে হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আগে ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’ এবং প্রবীণ নাগরিকদের দিতে হবে। আমাদের দেশে এই সংখ্যাটাও যেহেতু ৩০ কোটির কাছাকাছি, তাহলে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের কাছে কবে ভ্যাকসিন পৌঁছাবে? যাঁরা পয়সা খরচ করে ভ্যাকসিন কিনে নিতে পারেন, তাঁরা কি সেটা পারবেন না?
মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের মানষিকতা জানেন বলেই সিরাম কর্তা আদার পুনাও্য়ালা সরকারী টিকারকরণ কর্মসূচীর বাইরে মার্চ থেকে বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন, যাঁদের কাছে পয়সা আছে, তাঁরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবেন না। এবং এই অপেক্ষা না করতে চাওয়া জনসংখ্যার অংশটাও ভারতবর্ষে এতটা বড় যে সেটা ইউরোপের মোট জনসংখ্যার থেকে বেশি। ভারতের এই ভ্যাকসিনের বাজারটাকে যথাসম্ভব নিজেদের দখলে রাখতে যেমন পুনাওয়ালা উদগ্রীব, তেমনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত বায়োটেকও সামনে চলে এসেছে। সিরামের কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের কো-ভ্যাকসিন, এই দুটিকেই ভারত সরকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।
ভারতবর্ষের এই যে ভ্যাকসিনের বাজার এবং সরকারের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেদের খরচে ভ্যাকসিন নিতে জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ, এটা শুধু আজকের বাস্তব নয়, আগামীদিনেরও বাস্তব হতে চলেছে। যাঁদের সাধ্য আছে, তাঁরা করোনার ভ্যাকসিন তো নেবেনই, ভবিষ্যতে এই ধরনের আবার কোনও ভাইরাসের আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে তাঁরা আগেভাগেই প্র্রতিষেধক হিসাবে ভ্যাকসিন নেওয়ার দিকে ঝুঁকেও থাকবেন। সেটা পুনাওয়ালার মতো ভ্যাকসিন নির্মাতারা জানেন।
ওইজন্যই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম মাসের ইলেট্রিক খরচ, গ্যাসের খরচ, বাজার খরচের মতো এবার থেকে হয়তো ভ্যাকসিন খরচও থাকবে। ভারতের জনগণের একটা বড় অংশ বছরে একটি বা দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে নিজেদের নিরাপদ রাখাকেই শ্রেয় মনে করবেন।
লাল-নীল-গেরুয়া...! 'রঙ' ছাড়া সংবাদ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোন খবরটা 'খাচ্ছে'? সেটাই কি শেষ কথা? নাকি আসল সত্যিটার নাম 'সংবাদ'!
'ব্রেকিং' আর প্রাইম টাইমের পিছনে দৌড়তে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে সত্যিকারের সাংবাদিকতার। অর্থ আর চোখ রাঙানিতে হাত বাঁধা সাংবাদিকদের।
কিন্তু, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে 'রঙ' লাগানোয় বিশ্বাসী নই আমরা। আর মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন আপনারাই। সোশ্যালের ওয়াল জুড়ে বিনামূল্যে পাওয়া খবরে 'ফেক' তকমা জুড়ে যাচ্ছে না তো? আসলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই 'ফ্রি' নয়। তাই, আপনার দেওয়া একটি টাকাও অক্সিজেন জোগাতে পারে। স্বতন্ত্র সাংবাদিকতার স্বার্থে আপনার স্বল্প অনুদানও মূল্যবান। পাশে থাকুন।.