দশ অস্ত্রে বাংলা জয়ের লক্ষ্যে নেমেছে বিজেপি, সামলানো কঠিন হবে তৃণমূলের
পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে জয় করতে আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েছে বিজেপি নেতৃত্ব। উত্তর, মধ্য ভারত এবং পশ্চিম ভারতে বিজেপির দীর্ঘদিনের দাপট থাকলেও দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ভারতে এখনও পর্যন্ত বিজেপি সেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। তবে তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় সুযোগ পশ্চিমবঙ্গ। এরাজ্যে একবার জয় হাসিল করতে পারলে পূর্ব ভারতের বাকী রাজ্যগুলিতে এককভাবে বিজেপির সরকার গঠনের পরিস্থিতি তৈরি হবে। পাশের রাজ্য বিহারে বিজেপি যৌথভাবে সরকার গঠন করেছে। তবে বাংলায় যেভাবে বিজেপির ভোট বেড়েছে, তাতে আগামিদিনে বিজেপি যে এককভাবে রাজ্যে সরকার গড়বে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অর্থাৎ আগামী বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই জোরদার হতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় কোন কোন বিষয়কে হাতিয়ার করে বিজেপি ময়দানে নামছে তা কিছুটা আন্দাজ করা গিয়েছে ইতিমধ্যেই।

দল ভাঙানোর খেলা
বাংলায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানের ঢল নেমেছে। বিগত এক বছরে বহু ছোট-বড় নেতা থেকে শুরু করে একেবারে নিচু তলার তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা দলে দলে বিজেপিতে যোগদান করেছেন। কোচবিহার থেকে কাঁথি - দিকে দিকে অন্য দল থেকে এসে কর্মী-সমর্থকেরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সেই পরম্পরা বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত জারি রাখতে চাইছে গেরুয়া শিবির।

তপশিলি ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ভোট
যে সমস্ত জেলায় তপশিলি জাতি, উপজাতি এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি, সেসব জায়গায় গত কয়েক বছরে বিজেপি অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করেছে। এইসব এলাকার অনুন্নয়নকে হাতিয়ার করে তৃণমূল সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে। আর এভাবেই তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছে বিজেপি শিবির।

সাধারণ মানুষের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ
গত এক মাসের মধ্যে দু'বার বাংলায় এসে প্রত্যেকবারই একেবারে সাধারণ মানুষের বাড়ি বেছে নিয়ে সেখানেই দলবল নিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন অমিত শাহ, জেপি নাড্ডারা। এই বিষয়টিও তাদের ভোট রণকৌশলের অঙ্গ। কোনও এক জেলার কোনও এক দরিদ্র পরিবারের বাড়িতে হাজির হয়ে সেখানে মধ্যহ্নভোজ সেরে তাদের সঙ্গে জনসংযোগ করা, স্থানীয় বিভিন্ন অভিযোগের কথা শুনে সেটাকে হাতিয়ার করা, ইত্যাদি ভোট রণকৌশলের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

একেবারে গভীর নেমে জনসংযোগ
শুধু জেলায় জেলায় প্রচার নয়, জনসম্পর্ক অভিযান চালু করেছে বিজেপি। আর এই জনসম্পর্ক অভিযানের মাধ্যমে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার দলিত, আদিবাসী, কৃষক, ক্ষেতমজুর থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের অভাব অভিযোগ শুনে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কাজ চলছে।

বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি
বাম আমলে বামপন্থীদের সঙ্গে রাজ্যের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলের এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যা পরে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর হাইজ্যাক করে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। গত এক দশকে রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ তৃণমূলের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। তবে গত এক-দেড় বছরে সেই পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী প্রকাশ্যেই তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। এছাড়াও বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশকে নিজেদের পক্ষে আনতে সমর্থ হয়েছে বিজেপি। আরোও বেশি করে বুদ্ধিজীবীমহল যাতে বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ায় সেই প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।

ধর্মীয় স্থানগুলিতে আনাগোনা বাড়ানো
বিজেপি দলের একটি ধর্মীয় অবস্থান রয়েছে। সেই জায়গাকে আরও শক্তিশালী করতে রাজ্যের বিভিন্ন মন্দির এবং ধর্মীয় স্থানে, পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছে বিজেপি। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দির, কালীঘাট মন্দির, তারাপীঠ মন্দির থেকে শুরু করে ক্ষুদিরাম বসু, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিরসা মুন্ডা প্রভৃতি মহান ব্যক্তিত্বদের ভিটে দর্শন ও তাঁদের স্মরণ করে বাঙালি চেতনাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে বিজেপি।

উপকূল এলাকায় ফোকাস
বাংলায় বেশ কয়েকটি জেলা মিলিয়ে দীর্ঘ উপকূলবর্তী এলাকা রয়েছে। এবং এই এলাকা মূলত দীর্ঘদিন ধরে হতদরিদ্র অবস্থায় রয়েছে। এলাকার জীবনযাত্রার মান উন্নত নয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বেশিরভাগ মানুষই মৎস্যজীবী পেশার সঙ্গে জড়িত। এই এলাকায় বিজেপি নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে ধস নামাতে চাইছে।

আইনশৃঙ্খলার অবনতি
রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জেলায় পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিজেপি নেতারা সরব হতে শুরু করেছেন। রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা নেই, জঙ্গলের রাজত্ব চলছে। ইত্যাদি নানা কথা বলে তারা ইতিমধ্যে তৃণমূল সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। আগামী ভোট যত এগিয়ে আসবে ততই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলাকে প্রচারের হাতিয়ার হিসাবে বেশি করে ব্যবহার করা হবে। কারণ বেশ কয়েকটি জেলায় ইতিমধ্যে বিরোধী দলের কর্মীরা খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই ঘটনাকেই প্রচারের আলোয় এনে বিজেপি শাসক দলকে কোণঠাসা করবে।

কাটমানি ও দুর্নীতি
বাম আমলে সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানাভাবে জোরজুলুম করে সুবিধা ভোগ করার অভিযোগ উঠলেও, তৃণমূল আমলে গত দশ বছরে তা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ করে থাকে। তৃণমূল সরকারের আমলে ঘুষ বা কাটমানি না দিলে কাজ এগোয় না। বাড়ি তৈরি থেকে শুরু করে চাকরি - সবেতেই ঘুষ বা কাটমানি দিতে হয় বলে অভিযোগ। এটাকেও বিজেপি প্রচারের হাতিয়ার করে তুলেছে।

শীর্ষ নেতৃত্বকে টার্গেট
ইতিমধ্যে বিজেপির নেতারা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেমন টার্গেট করছেন, একইসঙ্গে তাদের প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পর্কে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো হন। এভাবেই জেলায় জেলায় নেতাদের ধরে ধরে বিজেপি টার্গেট করতে চলেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
শুভেন্দু অধিকারী কোনও ব্যতিক্রমী চরিত্র নন, বাংলার রাজনীতিতে দলবদলের ইতিহাস সাত দশক পুরনো