বিশেষ প্রতিবেদন: ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ডুবে গিয়েছিল সেই পাকিস্তানি জলদৈত্য৷ সে এক চিরস্মরণীয় নৌ যুদ্ধ৷ সাগর জলে মিশে থাকা সেই ইতিহাস রূপোলী পর্দায় ফিরে আসে বছর কয়েক আগে।
সঙ্কল্প রেড্ডি পরিচালিত ছবি ‘The Ghazi Attack’ ঘিরে কৌতুহল তীব্র আকার নেয়।
চার দশক আগের ইতিহাস৷ ভাষা ও আত্ম অধিকারের দাবিতে পাকিস্তান থেকে ছিন্ন হওয়ার লড়াই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ চালাচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ৷ সেই লড়াইয়ে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) লাখো জনতার পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত৷ প্রতিপক্ষ পাকিস্তান৷ সংঘর্ষের মধ্যেই ঘটেছিল অনেক নজির৷ তেমনই একটি ঘটনা পাকিস্তান নৌ সেনার (PNS) সর্বশক্তি সম্পন্ন সাবমেরিন ‘গাজী’র পতন৷ ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরের বুকে সলিল সমাধি হয়েছিল পিএনএস গাজীর৷ সেইসঙ্গে কোণঠাসা হতে থাকা পাকিস্তানের সব আশা শেষ হয়ে যায়৷ পিএনএস গাজীর সলিল সমাধির এগারো দিন পরই ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনা ঢাকায় ভারতের সামনে আত্মসমর্পণ করে৷ তৈরি হয় বাংলাদেশ৷
PNS GHAZI পাকিস্তান নৌ বাহিনীর নয়নের মণি
জন্ম লগ্ন থেকেই বারবার ভারতের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পাকিস্তানের শাসকরা বুঝেছিলেন নৌ শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে৷ দেশের দক্ষিণে আরব সাগর৷ যার অপর পাড়েই ভারত৷ সাহায্য করলল পাকিস্তানের কূটনৈতিক বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ১৯৬৪ সালে সেদেশে তৈরি ডুবোজাহাজ ‘USS Diablo’ তুলে দেওয়া হয় পাকিস্তানের হাতে৷ স্প্যানিশ ভাষায় এর মানে ‘শয়তান’৷ এর গতি প্রতি ঘণ্টায় ৩৭.৫০কিলোমিটার বা ২০.২৫ নটিক্যাল মাইল৷ ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে USS Diablo-কে করাচি বন্দরে পাকাপাকি নিয়ে আসেন৷ নতুন নাম হয় PNS GHAZI উর্দু গাজী শব্দের বাংলা অর্থ ‘বীর’৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে ‘USS Diablo’ মার্কিন নৌ সেনার অন্তর্ভুক্ত হয়৷ পঞ্চাশের দশকটি মার্কিন নৌ সেনার অন্যতম শক্তি হয়েই ভূগোলকের জল দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই সাবমেরিন৷
দ্বারকা আক্রমণ করেছিল পিএনএস গাজী
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ তার অন্যতম অধ্যায় ‘অপারেশন দ্বারকা’৷ পরিকল্পনা মতো পিএনএস গাজী আরব সাগর তোলপাড় করে পৌঁছে গিয়েছিল গুজরাটের উপকূলে দ্বারকা নগরীর প্রান্তে৷ ৭ সেপ্টেম্বর সাবমেরিন পিএনএস গাজী সহ আরও ৭টি পাক যুদ্ধ জাহাজ (PNS Babur, PNS Khaibar PNS Badr,PNS Jahangir,PNS Shah Jahan,PNS Alamgir,PNS Tippu Sultan) একযোগে গোলাবর্ষণ করে দ্বারকায়৷ কিন্তু দ্বারকা অক্ষত থাকে৷ ’৬৫ সালের যুদ্ধে পরাজয় হয় পাকিস্তানের৷ যুদ্ধক্ষেত্রে পিএনএস গাজীর আক্রমণাত্মক ভূমিকাকে সম্মান জানিয়ে পাকিস্তান সরকার তাকে ১০টি পুরস্কার দেয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পিএনএস গাজী
পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শুরু হতেই ভারতীয় নৌ বাহিনী পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে যায়৷ বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ আইএনএস ভিক্রান্তকে বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করা হয়৷ বঙ্গোপসাগরের তীরেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম বন্দর৷ বন্দরটি হাতছাড়া হতে পারে এই আশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান৷ তাঁর নির্দেশে পিএনএস গাজীকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়৷ লক্ষ্য আইএনএস ভিক্রান্তকে ধংস করা৷
আরব সাগরের তীরে করাচি থেকে ডুবোজাহাজ পিএনএস গাজী পুরো পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত পার করে পূর্ব প্রান্তে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যায়৷ অভিযানে অংশ নেন সাবমেরিন গাজীর কমান্ডার জাফর মহম্মদ খান৷ দলে মোট ৯২ জন পাক নৌ সেনা৷
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর৷ পাকিস্তান আক্রমণ শুরু করে৷ পশ্চিম সীমান্ত পার করে পাক বিমান বাহিনী ভারতের কয়েকটি স্থানে বোমা ফেলে৷ শুরু হয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ৷ আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর ছিল দু দেশের নৌ যুদ্ধের কেন্দ্র৷
জলের তলায় লুকোচুরি
আইএনএস ভিক্রান্ত অবস্থান করছিল বিশাখাপত্তনম বন্দরে৷ তাকে ধংস করাই হল গাজীর লক্ষ্য৷ অবশেষে পাক সাবমেরিনটি বিশাখাপত্তনামের কাছে পৌঁছে যায়৷ গাজী থেকে পাঠানো বিশেষ কোড ভেঙে সতর্ক হয় ভারতীয় নৌ সেনা৷ দ্রুত বিক্রান্ত-কে সরিয়ে দেওয়া হয়। গাজীকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয় ভারতীয় নৌ বাহিনী৷ কৌশলে বিক্রান্তের ছদ্মনামে একটি ভুয়ো কোড মেসেজ পাঠানো হয়৷ গাজীর ট্রান্সমিটারে ধরা পড়ে সেই বার্তা৷ তবে সেই মতো কাজ হয়নি৷ এরপরেই গাজীকে শেষ করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়৷ নিযুক্ত করা হয় ভারতীয় নৌবাহিনীর ডেষ্ট্রয়ার ‘আইএনএস রাজপুত -কে৷
ধংস হল পিএনএস গাজী
৪ ডিসেম্বর৷ আইএনএস রাজপুতের নজরে আসে বিশাখাপত্তনম বন্দরের কাছে জলে অস্বাভাবিক আলোড়ন৷ সেই দিকে সাবমেরিন ধংসের বোমা (ডেপথ) চার্জ করা হয়৷ প্রাথমিকভাবে কিছু বোঝা যায় নি৷ আধ ঘণ্টা পর বিশাখাপত্তনম উপকুলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়৷ ৫ই ডিসেম্বর সকালবেলায় স্থানীয় মৎস্যজীবীরা একটি জাহাজের লগবুক ও কিছু ছেঁড়া লাইফ জ্যাকেট পান৷ সন্দেহ দৃঢ় হওয়ায় ভারতীয় নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ নিশতার-কে সেই স্থানে পাঠানো হয়৷ নৌবাহিনীর ডুবুরিরা দেখেন সাগর তলায় পাক সাবমেরিন গাজী পড়ে রয়েছে৷ পরে ঘোষণা করা হয় পতন হয়েছে পিএনএস গাজীর৷ মৃত্যু হয়েছে ৯২ জন পাকিস্তানি নৌ সেনার৷ কয়েকজন পাক নৌ সেনার মৃতদেহ উদ্ধার করে সৎকার করে ভারতীয় নৌ বাহিনী৷ যদিও পাকিস্তানের দাবি, আইএনএস রাজপুতের নিক্ষিপ্ত বোমা বিস্ফোরণে ডুবোজাহাজ গাজীতে থাকা ১০টি টর্পেডো একসঙ্গে ফেটে গিয়েছিল৷ তাতেই ধংস হয় পিএনএস গাজী৷