সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অবিভক্ত পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলির একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলনেই শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্ব শাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা উল্লেখ করা হয়েছিল।
শেখ মুজিব এই দাবিকে “আমাদের বাঁচার দাবী” শিরোনামে প্রচারে নামেন৷ এই দাবির মূল বিষয় ছিল – একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত পাকিস্তানি ফেডারেশনের পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন। সেই দাবি সম্মেলনের উদ্যোক্তারা প্রত্যাখ্যান করেন এবং উল্টে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরপর তিনি সম্মেলন ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন।
মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামি লিগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে গোটা দেশই ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময় তিনি সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে বন্দিও হন। ৮মে নারায়ণগঞ্জে পাট কারখানার শ্রমিকদের এক র্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করার পর উত্তাল হয় দেশ এবং তার মুক্তির দাবীতে ৭ জুন দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের দিন পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে তিনজনের মৃত্যু হয়।
এদিকে সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক হয়ে জেলে দুই বছর থাকার পর ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল, শেখ মুজিবসহ অন্যান্যরা আগরতলায় ভারত সরকারের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে বসে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রের ছক কষা করেছিলেন৷ মামলায় শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামী করে পাকিস্তান বিভাগের মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এই মামলাকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে সর্বস্তরের মানুষ শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নামেন।
এরপর ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত একটি সর্বদলীয় সম্মেলনে ফের মুজিব তাঁর ছয়-দফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চাহিদাগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান৷ যথারীতি তা প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হবে৷ দেখা যায়, মুজিবের বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাঙালিদের জাতিগত ও সংস্কৃতিগত এই আত্মপরিচয় তাদেরকে একটি আলাদা জাতিসত্তা প্রদান করে। মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন এবং কার্যত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের সময়ে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু স্থানে ১৯৭১ এর জানুয়ারিতেও তা হয়। ওই নির্বাচনে মোট ২৪ টি দল অংশ নেয়।জাতীয় সংসদে ৩০০আসনে মোট ১,৯৫৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। তবে পরে কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থী পদ প্রত্যাহার করায় অবশেষে ১,৫৭৯ জন প্রার্থী ভোটে লড়েন। সেবার আওয়ামি লিগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্টগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ছিল ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়।
নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে প্রায় ৬৫% ভোট পড়ে বলে সরকার দাবী করে। সর্বমোট ৫,৬৯,৪১,৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩,১২,১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২,৩৭,৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার। জাতীয় সংসদে আওয়ামি লিগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে দ্বিতীয় থাকা পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছিল ৮৩টি আসন৷
কনজারভেটিভ দলগুলি নির্বাচনে খুব সুবিধা করতে পারেনি। পিএমএল (কাইয়ুম), পিএমএল (কাউন্সিল), পিএমএল (কনভেনশন), জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম, জমিয়ত উলেমা-ই-পাকিস্তান এবং জামায়াতে ইসলামী একত্রে ৩৭টি আসন পেয়েছিল৷ তখন একই সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচনও হয় এবং আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির ৩০০টি আসনের ২৮৮টি জিতে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের অপর চারটি এসেম্বলিতে তারা কোন আসন পায়নি। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের এসেম্বলীতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ভালো করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসনে জয় পায়নি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশ এবং বালোচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ওয়ালি) এবং পিএমএল (কাইয়ুম) ভালো ফল করেছিল।
যদিও জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করেছিল আওয়ামি লিগ তবুও নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে এক মেরুকরণ সৃষ্টি করে। মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করেন পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টো৷ এসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না। এমন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ইয়াহিয়া খানও সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বুঝতে পারে মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেওয়া হবে না।
এরপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন৷ তখন ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামি লিগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন৷
কিন্তু পাকিস্তান সরকার তখন মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করে রাখা হয়। অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী দমনের নামে অত্যাচার শুরু করে৷ রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে। তখন প্রচুর জনগোষ্ঠী সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ও পুলিশ রেজিমেন্টে কর্মরত পূর্ব বাংলার একদল বাঙালি মুক্তি বাহিনীর গড়ে তুলে বিদ্রোহ সংঘটিত করে। আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রথমে পাকিস্তানি সরকার মুজিবকে ছেড়ে দিতে রাজি হচ্ছিল না।
এরপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানি শাসকবৃন্দ মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি দেয়। এরপর তিনি লন্ডন হয়ে দিল্লিতে আসেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী’র সঙ্গে সাক্ষাতের পর জনসমক্ষে “ভারতের জনগণ, আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে সাধুবাদ জানান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফের বাংলাদেশে ফিরে আসেন। শুরু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গড়ার প্রক্রিয়া।