কলকাতা: মাত্রাতিরিক্ত গণতন্ত্রের জন্য আদৌ কি সংস্কার কঠিন হয়ে উঠছে? যদিও সম্প্রতি নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত এমনই বার্তা দিয়েছেন। তবে একথা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবীদ অভিরূপ সরকার এবং দুই সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ও জ্যোতিপ্রকাশ খান। যদিও সংস্কার এবং রাজনৈতিক দলগুলির আচরণ নিয়ে অবশ্যই কিছু প্রশ্ন আছে। তাছাড়া জোট রাজনীতি অনেক সময় সংস্কারের গতি মন্থর করে। এই নিয়ে তাঁরা তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
অভিরূপ সরকারের মতে, সংস্কার হলে কিছু লোকের যেমন ভালো হতে পারে তেমনি কিছু লোকের খারাপ হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে একদল প্রতিবাদ জানাবে সেটাই গণতন্ত্র। সরকার দাবি করছে, যা করা হচ্ছে তা সকলের জন্য মঙ্গল দায়ক। অর্থাৎ সরকার যেন সাধারণ মানুষকে বলে দিচ্ছে তাদের ভালোটা একমাত্র সরকারই বুঝতে পারে।
যা দেখে তাঁর মনে হয়েছে যৌথ পরিবারে জ্যাঠামশাই যেমনভাবে বাকিদের উপর তার মত চাপিয়ে দেন এটা অনেকটা সেই রকম। সংস্কারে ভুলও হতে পারে সেজন্যই আলাপ-আলোচনা দরকার হয়। সেক্ষেত্রে যদি ভাবা হয় গণতন্ত্রের জন্য সংস্কার আটকে যাচ্ছে তবে সেটা একটা ভয়ানক কথা বলে মনে করেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে সুমন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, এই সংস্কার তো মূলত আমেরিকার দেখাদেখি উন্নয়ন এবং মুক্তবাজারের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই মার্কিন সংবিধানেও বিরোধী কন্ঠকে গুরুত্ব দেয়। আর প্রতিবাদীরা সংখ্যা গরিষ্ঠ নাও হতে পারে। তাই বলে যদি তাদের প্রতিবাদ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় সেটা ভাবাটাও বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছে তাঁর।অন্যদিকে জ্যোতিপ্রকাশ খান মনে করেন, ঠিক কিসের সংস্কার, কাদের সংস্কার, কাদের জন্য সংস্কার এই নিয়ে একটা বিতর্ক কিন্তু থেকে গিয়েছে।
তাছাড়া অভিরূপ সরকারের মতে, একটা প্রচলিত ধারণা আছে যখন কোন দেশ উন্নতি করছে তখন সেখানে গণতন্ত্র উন্নতির পথে বাধা। যার উদাহরণ চিন বা দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু এই ধারণাটা ঠিক নয় তার কারণ পাল্টা উদাহরণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন, আফ্রিকার বহু দেশে গণতন্ত্র নেই সেখানে তো উন্নতি হচ্ছে না। তাছাড়া চিনে উন্নয়ন হলেও সেখানকার মানুষের জীবনের গুণগতমান আদৌ ভালো নয় বলে মনে করেন তিনি।
তবে এই তিনজনেই লক্ষ্য করেছেন রাজনৈতিক দলের অবস্থা পরিবর্তনের (অর্থাৎ শাসক থেকে বিরোধী) সঙ্গে সঙ্গে কোনটা ইতিবাচক সংস্কার আর কোনটা নেতিবাচক সংস্কার অদ্ভুতভাবে বদলে যায়। যেটা দেখে রাজনৈতিক দলের দ্বিচারিতা বলেও মনে হয়েছে অভিরূপ সরকারের। তিনি মনে করেন , ক্ষমতায় এলে কম বেশি সব দলই সংস্কারের পক্ষে থাকে। এই প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা সাধারণত যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে তারাই সংস্কারের সুবিধা নেন তুলনায় খেটে খাওয়া মানুষেরা সংস্কারপন্থী নন। আর দেখা যায় যে দল ক্ষমতায় ব্যবসায়ী সমাজ তাদের কাছাকাছি এসে পড়ে এবং ক্ষমতাসীন দলের উপর কিছু চাপ সৃষ্টি করে।
জ্যোতিপ্রকাশ খানের মতে, প্রাথমিকভাবে সংস্কারের বিরোধিতা করলেও দীর্ঘমেয়াদে হয়তো দেখা যায় সকলের তার সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু সংস্কারের পথে হাটতে গেলে একদল লোক সন্দেহের চোখে দেখে। আর সেটাই বোধহয় বিরোধীরা কাজে লাগাতে চায় ভোটের লড়াইয়ে।
এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, পশ্চিমী সমাজকে নকল করে যে অভিমুখে সংস্কার করে এগোনোর চেষ্টা করা হয় সেটা এ দেশের পক্ষে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। তাছাড়া সংস্কারের পথে এগোনর সময় পিছিয়ে পড়া মানুষদের উপর ভর করেই এগোতে হয় ফলে তাদের কথা শুনতে হয়।
আবার জোট রাজনীতির ফলে অনেক সময় সংস্কারের গতি মন্থর করে দেয় এমন অভিযোগও ওঠে।সুমন ভট্টাচার্য মনে করেন জোট রাজনীতি খারাপ নাও হতে পারে। তাছাড়া কোন শক্তিশালি সরকারের চেয়ে জোট সরকার সংস্কারের কাজ আরও ভালো করে সেরে ফেলতে পারে। তবে সংস্কার কেন করতে চাওয়া হচ্ছে সেটা মানুষকে বোঝাতে হবে।
অনেক সময় এই সংস্কার করাকালীন ‘হিউম্যান ফেস’ থাকে না বলেই সংস্কারের কাজে হাত দিতে গিয়ে সরকার পড়ে যায়। আবার অভিরূপ সরকারের অভিমত, জোট শরিকদের জন্য সংস্কারের গতি মন্থর হলেও তাদের মত নিয়েই এগোনটাই ভাল। কারণ সংস্কার জোর করে চাপিয়ে দিলে অনেক সময় মানুষ পথে নামতে পারে।
Kolkata 24 x7 এর প্রতিনিধি সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই তিন অতিথির আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এই সংক্রান্ত নানা কথা। অবশ্যই এই সব কথা বলতে গিয়ে নানা উদাহরণ প্রসঙ্গক্রমে তুলে ধরেছেন এই অতিথিরা।