সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: দুটো দেশ ভিন্ন সংস্কৃতি হলেও সেদিন দুজনের প্রেম হয়েছিল৷ সেই প্রেম থেকে পরিণয়টা যেন রূপকথার গল্প৷ কিন্তু তাদের জীবনে গল্পের শেষ মোড়টা অবশ্যই মর্মান্তিক৷ রাজীব এবং সোনিয়া গান্ধীর প্রেম পরিণয়ের ঘিরে রয়েছে আবেগময় এবং উষ্ণতার কাহিনি।
৬০ দশকের মাঝামাঝি কেমব্রিজে থাকাকালীন এক রেস্তোরাঁয় রাজীব প্রথম দেখেছিলেন সোনিয়াকে৷ হাতখরচের অর্থ জোগাড় করতে এক গ্রিক রেস্তোরাঁয় পার্ট টাইম কাজ করতেন তখন সোনিয়া মাইনো৷ রাজীবের ভাল লাগে তাই তিনি ওই রেস্তোরাঁর মালিক এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেন সোনিয়ার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে৷
সেই মতো ব্যবস্থা হয় তবে শোনা যায় এমন ব্যবস্থা করে দিতে ওই রেস্তোরাঁ মালিক মোটা টাকাই নিয়েছিলেন রাজীবের কাছ থেকে৷ তারপর হাতের কাছে থাকা ন্যাপকিনে ছোট্ট একটি কবিতা লিখে সবচেয়ে দামী পানীয়সহ তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সোনিয়াকে৷
তারপর আস্তে আস্তে পরিচয় থেকে প্রেমের দিকে ঝোঁকা৷ ওই সময় তাঁরা মাঝে মাঝে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতেন এবং শোনা যায় তাদের একসঙ্গে দেখা প্রথম ছবিটি নাকি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি৷
পরিচয়ের পর সোনিয়া জানতে পারেন রাজীব হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বড় ছেলে৷ লন্ডনেই মায়ের সঙ্গে সোনিয়ার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রাজীব৷ ইন্দিরা তখন লন্ডনে গিয়েছিলেন নেহরু এগজিবিশনে৷
সেই সময় ইন্দিরা সোনিয়াকে জানিয়েছিলেন, বিয়ে করার আগে সোনিয়া যেন ভারতে এসে কদিন থেকে যান৷ কারণ ভিন্ন সংস্কৃতি কতটা সোনিয়া মানিয়ে নিতে পারবেন সেই কথা ভেবেই এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সোনিয়াকে৷ অবশেষে ৬৭ সালের শেষের দিকে রাজীব দিল্লিতে ফেরেন আর ১৯৬৮সালের জানুয়ারিতে দিল্লি আসেন ২১ বছরের সোনিয়া৷ অবশ্য ততদিনে ইন্দিরা গান্ধী বুঝে গিয়েছেন রাজীব এবং সোনিয়া তাদের সম্পর্কের বিষয়ে সিরিয়াস ফলে তিনি আর তখন বিয়ে দিতে দেরি করেননি৷
তবে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে অবশ্য কিছুটা অমত ছিল সোনিয়ার বাবা স্টেফানো মাইনোর৷ তবে তিনি রাজীবকে অপছন্দ করেননি , তার আপত্তি ছিল কোনও রাজনৈতিক পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে ৷
সোনিয়া ভারতে এসে উঠেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বচ্চন পরিবারে৷ বিয়ের আগে শুধু দিল্লিতে বচ্চনদের বাড়িতে থাকাই নয় বিয়ের মেহেন্দি হয়েছিল সেখানেই৷ অমিতাভ বচ্চনের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন এই বিয়েতে একেবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন৷ অবশেষে ২৫ফেব্রুয়ারি তাদের বিয়ে হয়৷
পরের দিন হায়দরাবাদ হাউসে তাদের বিয়ের রিশেপশনে হাজির ছিলেন রাজনীতি ব্যবসায়ী জগতের মহারথীদের পাশাপাশি সেলিব্রিটিরাও৷ এই বিয়েতে মত ছিল না বলে আসেননি সোনিয়ার বাবা৷ তিনি না আসলেও বিয়েতে এসেছিলেন সোনিয়ার মা ও অন্য আত্মীয় পরিজন| বিয়ের পরে নতুন সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল সোনিয়ার৷
ভারতীয় ঐতিহ্য মেনে শাড়ি পরা থেকে শুরু করে হিন্দি ভাষা শেখা, সব কিছুই ধীরে ধীরে রপ্ত করেন তিনি৷ রাজনীতিতে ঢোকার তেমন কোনও ইচ্ছা ছিল না রাজীবের ৷ কিন্তু এমন পরিবারে জন্ম এবং নিয়তি নির্দেশ অমান্য করে কার সাধ্য৷ পাইলট হিসেবে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে যোগ দিয়েছিলেন রাজীব ৷
একে একে জন্ম হল রাহুল এবং প্রিয়াঙ্কার৷ বেশ চলছিল রাজীব সোনিয়ার সাংসারিক জীবন৷ তখন মা ইন্দিরার সঙ্গে ছোট ভাই সঞ্জয় পুরোদমে জড়িয়ে রয়েছেন রাজনীতিতে৷ কিন্তু ১৯৮০ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল সঞ্জয় গান্ধীর৷ এরপর ইন্দিরা রাজনীতিতে নিয়ে এলেন রাজীবকে ৷
তারপর ১৯৮৪ সালে দেহরক্ষীর হাতে ইন্দিরার মৃত্যুর পর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেখতে চাইল রাজীবকেই প্রধানমন্ত্রীর আসনে৷ ১৯৮৯ সালে তিনি ক্ষমতা হারান৷
তবে ১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুরে নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হল রাজীব গান্ধীর৷ তাঁর এমন মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুতে ইতি ঘটে রাজীব সোনিয়া দাম্পত্য জীবনের৷ সোনিয়ার এদেশে এমন পরিবারে বিয়ে হয়েছে যাদের বার বার অপঘাতে মৃত্যু ঘটনা ঘটছে৷
তবু তিনি পুত্র কন্যা নিয়ে ভারতেই থেকে গেলেন ৷ না চাইতেও জড়িয়ে গেলেন ভারতের রাজনীতিতে৷ যদিও বিদেশিনী বলে অনেক সময় তাঁকে নিয়ে বিরোধীরা কটাক্ষ করেছেন৷ তাই কংগ্রেস ক্ষমতায় আসলেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি ঠিকই, তবে তাঁর হাতেই রয়েছে কংগ্রেসের ক্ষমতার লাগাম৷