সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্যান্টিনে বসে একদল ছাত্রদের মধ্যে তুমুল তর্ক বেধে গিয়েছে ৷ একজনের অভিযোগ, বড় পত্রিকাগুলি নামী লেখকদের ছাড়া অন্য কারও লেখা ছাপে না। কারণ সদ্য লেখা পাঠিয়ে সে দেখেছে, সেটা মনোনীত হয়নি৷ প্রতিবাদ জানায় এক ছাত্র, নাম তাঁর প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়৷

তখনই একেবারে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় ছেলেটি,- সে গল্প লিখে পাঠিয়ে তা পত্রিকায় ছাপিয়ে দেখিয়ে দেবে৷ এরজন্য সে চেয়েছিল কয়েক মাস সময়৷ এই প্রবোধ অবশ্য সাহিত্যের ছাত্র ছিল না৷ তাঁর ছিল অংকে অনার্স৷ ঘটনাটা গত শতাব্দীর কুড়ির দশকের একেবারে শেষের দিক৷ কথা রেখেছিল ছেলেটি৷ তিনদিনের মধ্যে লিখে ফেলেছিল ‘অতসী মামী’ গল্প৷

আর জীবনের প্রথম গল্পটি নিয়ে সটান হাজির হয়ে ছিলেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার দফতরে। তবে এক্ষেত্রে লেখকের নামের জায়গায় প্রবোধ ব্যবহার না করে নিজের ডাক নামটাই লিখেছিলেন৷ ছাপা হয়েছিল সেই গল্প৷ শুধু তাই নয় পাঠক মহলে বেশ হই চই পড়েছিল ৷

যার জেরে বিচিত্রার সম্পাদক দেখা করলেন ছেলেটির সঙ্গে এবং লেখার জন্য সাম্মানিক কুড়িটা টাকা দেওয়ার পাশাপাশি পরামর্শ দিয়ে গেলেন আর গল্প লিখতে৷ ‘অতসী মাসী’ গল্পটি উল্লেখ করায় হয়তো অনেকেই বুঝতে পেরেছেন সেই প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রবোধ আসলে কে৷ যারা বুঝতে পারেননি তাদের জন্য বলে দিই এই প্রবোধই হলেন ‘পদ্মানদীর মাঝি’র স্রষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বিহারের সাঁওতাল পরগনা অর্থাৎ বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা নীরদাসুন্দরী দেবী। চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম৷ বাবার দেওয়া নাম ছিল প্রবোধকুমার আর ডাকনাম মানিক।

আই.এস.সি. পরীক্ষায় পাশ করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। কলেজে পড়াকালীন ঝুঁকলেন সাহিত্যের দিকে৷ তার উপর জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয় বাম রাজনীতিতে। ফলে বরাবরের ভাল রেজাল্ট করা এই ছাত্র প্রবোধের কলেজের লেখাপড়া একেবারে শিকেয় উঠল৷

হাতে নাতে ফলও পেলেন, বিএসসি-তে পরপর দু’বার ফেল। সব কথা শুনে রেগে গেলেন মানিকের বড়দা৷ কারণ তিনিই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলেন, – ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হলেও তিনি তা না করে বার বার পরীক্ষায় ফেল করেছন কে? দাদা তাঁকে পড়াশুনায় মন দিতে বলায় জবাবে মানিক জানিয়ে দেন,- লেখা এবং রাজনীতি তাঁর পক্ষে তখন ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

রেগে গিয়ে দাদা ভাইকে টাকা পাঠানো বন্ধ করলে, মানিক ফের চ্যালেঞ্জের সুরেই দাদাকে জানিয়েছিলেন- তিনি ভবিষ্যতে একেবারে প্রথম শ্রেণির বাংলা লেখকদের মধ্যে স্থান পাবেন, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের সঙ্গে উচ্চারিত হবে৷ এটা ঠিকই বাংলার প্রথম সারির একজন লেখক হতে পেরেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷

কিন্তু এই লেখককে তাঁর জীবদ্দশায় রীতিমতোই দারিদ্রের সঙ্গেই সংগ্রাম করতে হয়েছে৷ ছাত্রাবস্থায় দাদা টাকা পাঠানো বন্ধ করলে মানিকের শুরু হল প্রকৃত দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই। চলে আসেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেসে৷ তখন দিনরাত এক করে মানিক শুধু লিখছেন এবং প্রকাশকদের দোরে-দোরে ঘুরছেন।

সেই সময় কলকাতায় এসেছিল এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল। কার্নিভালের তাদের নাচ দেখে এমনই মুগ্ধ হলেন যে ওইসব মানুষদের নিয়ে লিখতে শুরু করলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। একের পর এক বিরল সাহিত্য সৃষ্টির কাজ চলছিল যখন তখনই আবার বিয়ে করেছেন তিনি৷ সন্তান হয়েছে, বেড়েছে সংসার ৷ লেখালেখির পয়সা দিয়ে সংসারের চলে না৷ ফলে বাধ্য হলেন চাকরি খুঁজতে৷ কিন্তু তিনি ঠিক চাকরি করে উঠতে পারেননি৷

একসময় ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সাপ্তাহিক বিভাগের জন্য সহকারী সম্পাদক চাকরি পেলেন মাইনে ছিল ৮৫ টাকা ৷ তাছাড়া শর্ত ছিল ‘অমৃতস্য পুত্রা’ ধারাবাহিকভাবে লেখার। এ জন্য প্রতি মাসে আরও ১০ টাকা। বেশিদিন সেই চাকরি তিনি করতে পারেননি৷ চাকরি ছাড়লেন ৷ ১৯৪৪ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।

জীবনের প্রথমভাগে তিনি ফ্রয়েডের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আবার মার্কসবাদও তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তার অধিকাংশ রচনাতেই এই দুই মতবাদের নিবিড় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে মানিক ছিলেন মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তারাধিকারী।

১৯৪৬ সালে প্রগতিশীল লেখক সংঘের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।তখন ভারতের দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। এমনিতেই আর্থিক কষ্ট ছিল আরেক ফ্যাসাদ নেমে এলো জীবনে ১৯৫০ সালে৷ কমিউনিস্ট হওয়ার দরুন সরকারি দমননীতির জেরে বহু পত্রপত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিল৷

শেষে ফের প্রতিষ্ঠিত দাদার কাছে টাকা ধার চেয়ে চিঠি লিখলেন৷ ধার দিতে রাজি না হলেও ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করতে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়তে রাজি হলেন দাদা৷ কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে সেই ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ফলে তীব্র আর্থিক কষ্ট নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল এই লেখকের৷ মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন যা পরবর্তী কালে জটিল আকার ধারণ করে।

বেশ কিছুদিন রোগভোগের পর ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বমোট ৪০ টি উপন্যাস এবং ৩০০ টি ছোট গল্প রচনা করেছেন। তাঁর মধ্যে বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস নিয়ে সিনেমা হয়েছে৷ শুধু তাই নয় পরবর্তীকালে তার সাহিত্য সৃষ্টি অন্য ভাষাতেই অনুবাদ হয়েছে৷ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’দেশিয় এবং বিদেশি মিলে ১৩টি ভাষায় এবং ‘পদ্মানদীর মাঝি’ দেশিয় এবং বিদেশি মিলে ১৫টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে ৷

জেলবন্দি তথাকথিত অপরাধীদের আলোর জগতে ফিরিয়ে এনে নজির স্থাপন করেছেন। মুখোমুখি নৃত্যশিল্পী অলোকানন্দা রায়।