কেন রাত পেরোতেই বদলে গেল তৃণমূল-শুভেন্দু রসায়ন? পট পরিবর্তনের নেপথ্যে কোন কারণ?
সব কিছু ঠিক ছিল। মঙ্গলবার রাতে বহুদিন পরে তৃণমূল সমর্থকরা মনে হয় শান্তিতে ঘুমিয়েছিলেন। তবে এদিন দুপুরেই চিত্রটা পুরোপুরি বদলে যায়। সংবাদমাধ্যমে শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ মহল জানায় যে বৈঠক নিয়ে সৌগত রায়ের মুখ খোলা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছেন শুভেন্দু। তিনি নাকি সেই বার্তা সৌগত রায়কে এসএমএস-এর মাধ্যমে জানিয়েছেন। সূত্রের খবর, শুভেন্দু লিখেছেন, এভাবে একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব না।

ছন্দপতনের নেপথ্যে কোন কারণ?
এরপরই প্রশ্ন ওঠে. হঠাৎ এই ছন্দপতনের নেপথ্যে কোন কারণ? আপাত দৃষ্টিতে শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ শিবিরের তরফে বলা হচ্ছে যে বৈঠকে কোনও সমাধান সূত্র বের হয়নি। এভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে সৌগত মুখ খোলায় দলের তরফে তাঁদের সিদ্ধান্ত চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে শুভেন্দুর উপর। যা নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন শুভেন্দু।

কেন এতটা উষ্মা প্রকাশ শুভেন্দুর?
তবে এইটুকু কথায় কেন এতটা উষ্মা প্রকাশ শুভেন্দুর? একটি বৈঠক যদি ইতিবাচক হয়ে থাকে, তাহলে সেই বিষয়ে মুখ খোলা নিয়ে সৌগত রায়ের মতো এত বর্ষীয়ান এক নেতার সঙ্গে কেন এত কঠোর ভাষায় বার্তা দেবেন শুভেন্দু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, শুভেন্দুর এই রাগ শুধুমাত্র সৌগত রায়ের মুখ খোলা নিয়ে নয়।

মূল সমস্যা
জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার, সৌগত রায়ের তরফেই সেই হাইভোল্টেজ বৈঠকের রূপরেখা তৈরি হয়েছিল। বৈঠকে শুভেন্দু অধিকারী, সৌগত রায় ছাড়াও ছিলেন প্রশান্ত কিশোর, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে সূত্রের খবর, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে নাকি বৈঠকে বসতেই চাননি শুভেন্দু অধিকারী। কারণ, তাঁর দলে মূল সমস্যা তাঁদেরকে নিয়েই।

অভিষেক-শুভেন্দু দূরত্ব
মূলত যেদিন থেকে তৃণমূল যুবর সভাপতি পদ থেকে শুভেন্দুকে সরিয়ে সেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বসানো হয়, সেদিন থেকেই অভিষেকের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে শুভেন্দুর। দলীয় কর্মীদের মধ্যে শুভেন্দুকে নিয়ে উন্মাদনা একটা সময় এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে দলের তৃণমূল স্তরের কর্মীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প হিসাবে শুভেন্দুকেই দেখতে শুরু করে।

দলের রাশ কার হাতে?
যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পর এই দলের রাশ দিতে চেয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। এই কারণেই যেভাবে যেভাবে দলে অভিষেকের দাম বেড়েছে, ততই দল থেকে দূরে গিয়েছেন শুভেন্দু। এরপর সারদা কাণ্ডের মাঝে মুকুল রায় দল পরিবর্তন করে গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন। এরপর থেকেই বিগত কয়েক বছর ধরে বজায় ছিল শুভেন্দুর দল বদলের জল্পনা।

জল্পনার সুর সপ্তমে চড়ে বিগত কয়েক মাস ধরে
তবে শুভেন্দুর তৃণমূল ছাড়া নিয়ে জল্পনার সুর সপ্তমে চড়ে বিগত কয়েক মাস ধরে। গত প্রায় দুই-তিন সাম ধরে শুভেন্দু একের পর এক অরাজনৈতিক মঞ্চে সভা করে আকারে ভঙ্গিতে আক্রমণ শানিয়েছেন দলকে। মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকলেও দল যে ধীরে ধীরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোরের হাতে চলে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরেছেন শুভেন্দু। আর তাতেই তাঁর আপত্তি।

অভিষেকের অধীনে কাজ করবেন না শুভেন্দু
শুভেন্দু অভিষেকের অধীনে কাজ করতে পারবেন না, তা বলাই বাহুল্য। এই অবস্থায় মমতার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অভিষেক নিজেও আক্রমণ শানিয়েছেন শুভেন্দুকে। নাম না করে আক্রমণ প্রতি আক্রমণে পারদ জমছিল দুপক্ষেই। কখনও লিফট প্রসঙ্গ। কখনও আবার প্যারাসুট। তারই মাঝখানে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়া। অপরজনের সরাসরি কটাক্ষ। শুভেন্দু অধিকারী আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে এক অদৃশ্য ফাটল যেন ক্রমেই বাড়ছিল। সূত্রের খবর, মঙ্গলবারের বৈঠকে সেই দূরত্ব মিটে যায়নি। যদিও সেই দাবি করা হয়েছিল সৈগত রায়ের তরফে।

আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে তৃণমূলের অন্দর থেকেই
শুভেন্দু পর্ব যত তীব্র হয়েছে নাম না করে তাঁকে আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে তৃণমূলের অন্দর থেকেই। এমনকী শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেন প্রথম থেকে খড়্গহস্ত দেখা গেছিল শুভেন্দুর প্রতি। দুরত্ব বাড়ার ইঙ্গিত মিললেও বা কল্যাণের আক্রমণের সুর চড়লেও এই আইনজীবী সাংসদ কিন্তু নেত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন ক্রমাগত। সাম্প্রতিক কিছু সফরেও কল্যাণকে মমতার সঙ্গে দেখা গিয়েছে। সেই সব ভুলে এত সহজেই কি শুভেন্দু দলে ফিরে যাবেন, গতকালকের বৈঠকের পর এই প্রশ্নই উঠেছিল।

শুভেন্দুর মনে কোন পরিকল্পনা
এই পরিস্থিতিতে ক্ষণিকের জন্যে তৃণমূলে স্বস্তি ফিরলেও শুভেন্দুর মনে যে অন্য পরিকল্পনা রয়েছে, তা স্পষ্ট। এই অবস্থায় দুটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই তাল কাটার পিছনে। এক হতে পারে, শুধুমাত্র সৌজন্যতার খাতিরেই গতকাল বৈঠকে ছিলেন শুভেন্দু। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের রূপরেখা তলায় তলায় তৈরি হয়েই আছে। এবং এই কারণেই বিজেপি শিবিরও হয়ত এখনও আশাবাদী। বা হতে পারে শুভেন্দু নিজের মঞ্চ তৈরি করতে চলেছেন।

মুর্শিদাবাদের নেতৃত্বের সঙ্গে শুভেন্দুর বৈঠক ঘিরে জল্পনা
উল্লেখ্য, সৌগত রায়কে পাঠানো শুভেন্দুর এই বিস্ফোরক বার্তা গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার আগেই মুর্শিদাবাদের তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন শুভেন্দু। বুধবার সকালের সেই বৈঠক বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মূলত মুর্শিদাবাদ এবং মালদার কংগ্রেস প্রভাবিত এলাকায় তৃণমূলের ভিত গড়ে দেওয়ার মূল কারিগর ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। এর আগে শুভেন্দুর পদত্যাগের পরদিনই মালদার নেতৃত্বের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক ডাকলেও সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন মৌসম বেনজির নূর। যা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল বিস্তর। শুভেন্দুর ভবিষত পরিকল্পনার উপর থেকে যবনিকা পতনের অপেক্ষায় গোটা বঙ্গ রাজনৈতিক মহল।
শুভেন্দু অধিকারী নিয়ে হাল ছাড়ল তৃণমূল? 'হতাশ' সৌগত রায়ের বক্তব্যে জোর জল্পনা