সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়: সাড়ে তিন দশক আগে ভারতে ঘটে গিয়েছিল বিশ্বের শিল্পের ইতিহাসে এক চরম বিপর্যয়৷ মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের কীটনাশক কারখানা থেকে দুর্ঘটনাবশত বিষাক্ত মিথাইল আইসোসানাইট (MIC)পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ যার প্রভাবে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়৷

তবে এমন ঘটনা ঘটলেও পার পেয়ে গিয়েছিলেন সংস্থার কর্তা৷ ইউনিয়ন কার্বাইডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসন৷ ভোপালে গ্রেফতার হলেও, দিল্লি থেকে আসা এক রহস্যজনক ফোনের জন্য তাঁর ‘সেফ প্যাসেজ’ এর ব্যবস্থা হয়ে যায়৷ এই কর্পোরেট ক্রিমিনাল প্লেনে চড়ে এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান মার্কিন মুলুকে৷ তারপর বিচারের জন্য বার বার ডাকা হলেও তিনি এদেশে আসেননি৷ শাস্তি এড়িয়ে থেকেছিলেন আজীবন৷

১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর গভীর রাত আর ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঘটেছিল দুর্ঘটনা৷ মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড রাসায়নিক ফ্যাক্টরির ‘প্ল্যান্ট নাম্বার সি’ থেকে গ্যাস লিক করে৷ সেই বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে মিশে গিয়ে ঘুমের মধ্যে কেড়ে নেয় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ৷ ইউনিয়ন কার্বাইড ফ্যাক্টরি থেকে ৪০ টন বিষাক্ত মিথাইল আইসোসানাইট গ্যাস লিক করেছিল৷ বাতাসে এই গ্যাস মিশে গেলে সেই বায়ু মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু নিশ্চিত৷ তাই ঘটেছিল৷

সেই রাতের দুর্ঘটনার পর তদন্ত করে জানা যায়, ‘প্ল্যান্ট নাম্বার সি’তে জলের সঙ্গে মিথাইল আইসোসানাইট গ্যাস মেশানো হয়েছিল৷ মিশ্রণ জনিত কারণে গ্যাস ঘনীভূত হতে থাকে৷ একটা সময়ে গ্যাসের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে ট্যাঙ্কে প্রবল চাপ তৈরি করে৷ এরপরই ট্যাঙ্ক থেকে গ্যাস বেরিয়ে আসতে থাকে৷ বাতাসের মধ্যে সেই গ্যাস মিশে গিয়ে ভোপালের বহুলাংশে ছড়িয়ে পড়ে৷ মধ্য রাতে ঘুমের মধ্যে মারা যান বহু মানুষ৷ সরকারি হিসেব অনুযায়ী সেই দুর্ঘটনায় ৩৭৮৭ জন মারা যান৷

যদিও বিভিন্ন সংগঠনের দাবি অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা আট হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল৷ এছাড়া সেই দুর্ঘটনার জেরে শারীরিক ভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন বহু মানুষ৷ ২০০৬ সালে হলফ নামায় তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ সরকার জানায়, গ্যাস লিকের কারণে ৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ১২৫ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ যার মধ্যে ৩৯০০ জন আংশিক ও পুরোপুরিভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যান৷

এই গ্যাস দুর্ঘটনায় প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতিও ধরা পড়েছিল৷ তখন ওই প্ল্যান্টের এলার্ম সিস্টেম ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকেজো হয়ে পড়েছিল ফলে তা সেদিন কাজই করেনি৷ ফ্যাক্টরি ম্যানেজারও কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেননি৷ ১৯৮৪ সালে ভোপালের জনসংখ্যা ছিল ৮ লক্ষ ৫০ হাজার৷ এখনকার তুলনায় সেই সময় ভোপালের পরিকাঠামো ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না৷ হাসপাতালের সংখ্যাও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম৷

গ্যাস লিকের কয়েক ঘণ্টার পরই শহর যেন মৃত্যু নগরীতে পরিণত হতে থাকে৷ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হিড়িক পড়ে যায়৷ শ্বাসকষ্ট, চোখ ও ত্বকের সমস্যা, বুকে জ্বালায় শহরবাসী ছটফট করতে থাকে৷ ডাক্তাররাও প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি এই রোগের কারণ ও তার চিকিৎসা কি? শহরের দুটি সরকারি হাসপাতালে প্রথম দু’দিনে ৫০ হাজার মানুষ ভর্তি হন৷ পরে সরকারের তরফ থেকে দুর্ঘটনায় মৃত ও আহতদের পরিবারকে মোট ৭১৫ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়৷ সেই সময় এই মর্মান্তিক ঘটনায় সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল সিবিআই৷

বেশ কিছু রিপোর্ট মনে করে ওই সময় আমেরিকা থেকে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপর রীতিমতো চাপ এসেছিল অ্যান্ডারসনকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে৷ শাস্তি এড়িয়ে বিদেশে পালানোর বহু বছর পর ২০১৪ সালে ৯২ বছর বয়েসে অ্যান্ডারসনের ফ্লোরিডায় মৃত্যু হয়৷ তবে আজও যেটা অজানা রয়ে গিয়েছে দিল্লি থেকে আসা একটা ফোন কলের ব্যাপারটা- সেটি ঠিক কে করেছিল যার জন্য গ্রেফতার হয়েও ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন এই বিদেশি শিল্পকর্তা৷ দিল্লি থেকে সেই রহস্যজনক ফোন কলটি যখন এসেছিল তখন অ্যান্ডারসন ছিলেন সংস্থার গেস্ট হাউসে গৃহবন্দি৷ কথিত ওই দুর্ঘটনার পর তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং এর কাছে দিল্লি থেকে একটি ফোন কল এসেছিল যাতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অ্যান্ডারসনকে যেন অবিলম্বে যেতে দেওয়া হয়৷

এই ঘটনা সম্পর্কে যিনি সদুত্তর দিতে পারতেন তিনি হলেন অর্জুন সিং ৷ কিন্তু তিনিও ২০১১ সালে মারা যান৷ তাছাড়া তিনি স্পষ্ট করে না বললেও যা জানিয়েছিলেন তাতে যেন বিষয়টি আরও গুলিয়ে গিয়েছিল৷ তাঁর আত্মজীবনী ‘A Grain of Sand in the Hourglass of Time’ বইটিতে তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব আরডি প্রধানের নাম উল্লেখ করেছেন৷ অর্জুন দাবি করেন স্বরাষ্ট্র সচিব সেই ফোনটি করেছিলেন৷ অর্জুন সিংয়ের বক্তব্য, তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওয়ের নির্দেশে ওই ফোন কলটি এসেছিল৷ যদিও আরডি প্রধান এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাঁর স্বপক্ষে যুক্তিতে দাবি করেছেন, সেই সময় তিনি আদৌ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব নন ওই সময় তিনি ছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যসচিব৷ তিনি ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব হয়েছিলেন৷

তাছাড়া ১৯৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর সিবিআই এই কেসটি নেওয়ার পরে অ্যান্ডরসনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল৷ ওই বিপর্যয়ের চারদিনের মাথায় ৭ ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের পুলিশ অ্যান্ডারসনকে ভোপালে এলে তাঁকে গ্রেফতার করে৷ তবে তারপরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউনিয়ন কার্বাইডের গেস্ট হাউসে ,সেখানেই তিনি গৃহবন্দি ছিলেন৷
কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠে এমন ঘটনার পরেও পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার পর কেন থানায় না নিয়ে গিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছিল তাঁরই সংস্থার গেস্ট হাউসে৷ ইউনিয়ন কার্বাইডের সেই গেস্ট হাউসে থাকাকালীন অ্যান্ডারসন ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি কোম্পানির আইনি পরামর্শদাতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন৷ ওই সময় ৬৩ বছরের মার্কিন শিল্পকর্তা নাকি কারখানায়ও যেতে চেয়েছিলেন তবে স্থানীয় প্রশাসন তখন তাঁকে তেমন অনুমতি দিতে রাজি হয়নি৷

সেই সময় যখন একেবারে ভোটের প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন অর্জুন সিং তখনই নাকি তিনি ওই বিশেষ ফোন কলটি পেয়েছিলেন৷ তারপরেই তিনি তাঁর আধিকারিকদের ওই মার্কিনিকে অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অ্যান্ডারসন মুক্তি পেয়ে যান৷ অভিযোগ তারপরেই একেবারে সেখানকার এসপি এবং ডিএম তাঁকে এস্কট করে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন৷ শুধু তাই নয় একেবারে রাজ্য সরকারের নির্দেশ মতো প্লেনে করে তাঁকে দিল্লি পাঠান হয়৷ অ্যান্ডরসনকে ২৫হাজার টাকার বন্ডে ছাড়া হয়েছিল৷ ওই বন্ডের সময় তিনি কথা দিয়েছিলেন এই সংক্রান্ত মামলায় তাঁকে ডাকা হলে তিনি ভারতে ফিরে আসবেন৷ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আদৌ রাখেননি ওই মার্কিনি সাহেবটি৷

এদিকে ভোপালের কালেক্টর মোতি সিং জানিয়েছিলেন, সেই সময় গৃহবন্দি থাকাকালীন ঘরে থাকা একটি ফোন থেকে অ্যামেরিকায় কোনও লোকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন অ্যান্ডারসন যাতে তাঁকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূতও ভারতীয় সরকারের উপর চাপ দিচ্ছিল তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য৷ তদন্ত কমিশনের সামনে ভোপালের তৎকালীন এসপি স্বরাজ পুরি জানিয়েছিলেন,অ্যান্ডারসনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল লিখিত নির্দেশে কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল মৌখিক নির্দেশে৷ একেবারে উচ্চমহল থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ এসেছিল৷

৭ ডিসেম্বর যে উড়ানে চড়ে অ্যান্ডারসন ভোপাল থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন সেই উড়ানের পাইলট সৈয়দ হাফিজ আলি জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে একজন কোনও ভিআইপিকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল৷ তিনিই যে অ্যান্ডারসন দিল্লি আসার আগে সে কথা এই পাইলট জানতেন না৷ তাছাড়া দিল্লিতে নামার পর অ্যান্ডারসন কোনও কথা না বলেই একটি গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যান ফলে তাঁর সঙ্গে কোনও কথা বলার সুযোগ হয়নি৷ যদিও কার নির্দেশে কাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁর প্রমাণস্বরূপ ওই উড়ানের লগবুকটি এখন আর এই দেশে নেই৷ওই এয়ারক্রাফট হাত বদল হয়ে পরে বিদেশি সংস্থার হাতে চলে গিয়েছে ৷

দেশে এবং বিদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে টানা দু'দশক ধরে কাজ করেছেন । বাংলাদেশ থেকে মুখোমুখি নবনীতা চৌধুরী I