আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে ভিন্নতা কাটছে না। তারা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। তবে এখনো সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেননি। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে - উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ হলেই রূপরেখা দেয়া হবে।
দলের দায়িত্বশীল নেতারা নিশ্চিত করেছেন, তাদের রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে অথবা ক্ষমতাহীন করে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ অধীনে ভোট অনুষ্ঠানের কথা থাকছে। জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবিও সন্নিবেশিত আছে। তবে বাস্তবতা হলো-বিএনপির সহায়ক সরকারের দাবিটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে কোন ফর্মুলায় নির্বাচন সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে গত বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংবিধানে সহায়ক সরকারের কোনো বিধান নেই। বিএনপি অসাংবিধানিকভাবে সহায়ক সরকারের দাবি করে আসছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবৈধ দাবি করা বিএনপির অভ্যাস। এ কারণে এখন বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠানের দাবি করছে। আবার কোনো কোনো নেতা সংবিধান সংশোধনের দাবিও তুলেছেন।
এই জটিল পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রাখছেন। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলে আসছেন, শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিবে না। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে বেগম জিয়া বলেন, ‘আমরা শেখ হাসিনা ও এই পার্লামেন্টের অধীনে নির্বাচনে যাবো না। বিএনপি নির্বাচনে যাবে, তবে সে নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। এই পার্লামেন্ট রেখে নির্বাচন হবে না। আর শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচন হবে না। কারণ, সারা পৃথিবী বুঝে গেছে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, হবে না।’
গত ২৭ জানুয়ারি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ছাড়া আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বিএনপি। পরদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। সেই অংশগ্রহণের পথে বাধা সৃষ্টি করার চক্রান্ত বা অপচেষ্টা দেখছি আমরা। খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার জন্য যদি অন্যায়ভাবে চেষ্টা করা হয় তাহলে বিএনপির কেউ নির্বাচনে অংশ নিবে না। একই দিন বেগম জিয়ার সভাপতিত্বে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ‘খালেদা জিয়া ছাড়া তারা নির্বাচন বর্জন করবে।’
এদিকে সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচনে অংশ নেব না এ কথা একবারও বলিনি।’ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সব মেশিনারিজ থাকে সরকারের হাতে। আমরা একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই।’
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর বনানী কবরস্থানে আরাফাত রাহমান কোকোর কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গত মঙ্গলবার গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলে এসেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। শেখ হাসিনার অধীনেই যদি বিএনপি নির্বাচনে যেত, তাহলে সেটা ২০১৪ সালেই যাওয়া যেত। পাঁচ বছর পরে কেন যাবে? নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে আত্মহত্যার শামিল। আত্মহত্যা যারা করে জনগণ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না।’ গয়েশ্বর রায় বলেন, আমাদের দলের মধ্যে নানা রঙের লোক আছে, নানা বর্ণের লোক আছে, নানা মতের লোক আছে। কে, কী ভাবছে, সেটা আমরা জানি না। তবে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবো না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। যত চেষ্টা যত ষড়যন্ত্রই করা হোক না কেন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। যদি যেতো তাহলে ৫ বছর আগেই যেতো। এতো আন্দোলন, নির্যাতন সহ্য করতে হতো না। সরকারের সামনে এখনো সমঝোতার পথ খোলা রয়েছে। দাবি না মানলে আন্দোলন করে দাবি আদায় করা হবে।
ইত্তেফাক/নূহু